একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার স্বীকৃতি পাওয়া একাধিক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবার দ্বিতীয়বারের মতো বিজয় দিবস কাটাবেন কারাগারে। চব্বিশের জুলাই–আগস্ট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দায়ের হওয়া রাজনৈতিক মামলায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দায়িত্ব পালন করা সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে বর্তমানে কারাবন্দি।
২০২৪ সালের আগস্টের পর সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে অন্তত ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধার কারাবন্দিত্বের তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহি বীর বিক্রম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, মুজিববাহিনীর সদস্য শাহজাহান খান, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীর প্রতীক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক চিফ হুইপ আব্দুস শহীদসহ একাধিক সাবেক সংসদ সদস্য।
এছাড়া জেলা ও স্থানীয় পর্যায়েও মুক্তিযোদ্ধা নেতারা কারাবন্দি রয়েছেন। মেহেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার মতিয়ার রহমান এবং যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বর্তমানে কারাগারে আছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও মুক্তিযোদ্ধা আটক থাকলেও তাদের পরিচয় পূর্ণাঙ্গভাবে নিশ্চিত করা যায়নি।
গত ৮ ডিসেম্বর জুলাই–আগস্ট আন্দোলন ঘিরে দায়ের হওয়া হত্যা ও গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ ১৭ জনকে হাজির করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, এসব আসামির মধ্যে অন্তত আটজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রসিকিউশন বলছে, আসামিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ, কারফিউ জারির সুপারিশ ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ভূমিকার অভিযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম বলেন, “আসামিদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই জুলাইয়ের মানবতাবিরোধী অপরাধে সম্পৃক্ততার প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে।” তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক পদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে তারা সহিংসতার পথ সুগম করেছেন।
তবে এসব মামলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার সংগঠন ও আইনজীবীরা। তাদের মতে, একসঙ্গে শতাধিক নাম উল্লেখ করে দায়ের করা মামলার গ্রহণযোগ্যতা ও তদন্তের মান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। ঢাকায় বসে অন্য জেলার মামলায় সরাসরি আসামি হওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান স্বীকার করেছেন, জুলাই দাঙ্গার পর অসংখ্য মিথ্যা মামলা হয়েছে। তিনি জানান, এসব অপব্যবহার ঠেকাতে ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১৭৩(ক) ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যাতে পুলিশ সুপার বা কমিশনার প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দিতে পারেন।
এদিকে কারাগারে বন্দি একাধিক মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনাও আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, ১৯৭১ সালের পরাজিত শক্তির অনুসারীরা ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে একাত্তারে তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বারংবার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আঘাত-আক্রমণ-অবমাননা-অপমান করে চলেছে। সেই প্রতিশোধের অংশ হিসেবেই একাত্তরের এই নায়কেরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন।
একাত্তরের বিজয়ের সঙ্গে যুক্ত বহু মুখ এবারও বিজয় দিবস উদ্যাপন করবেন কারাগারের চার দেয়ালের ভেতরে যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গভীর ও বিতর্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকছে।