সর্বশেষ

বিনোদবাড়ি মানকোন বধ্যভূমি

একদিনে ২৫৩ জনকে হত্যা, দেখিয়ে দিয়েছিল রাজাকাররা

প্রকাশিত: ৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:৫৮
একদিনে ২৫৩ জনকে হত্যা, দেখিয়ে দিয়েছিল রাজাকাররা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার চারটি গ্রামে সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ গণহত্যা। স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা বিনোদবাড়ি, মানকোন, দড়িকৃষ্ণপুর ও কাতলসা গ্রামে নারী-শিশুসহ ২৫৩ জনকে একদিনে হত্যা করে। অন্তঃসত্ত্বা নারী থেকে শুরু করে শিশু পর্যন্ত কেউ রক্ষা পায়নি।

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত চলে এই হত্যাযজ্ঞ। দড়িকৃষ্ণপুর গ্রামের বলবাড়িতে একসঙ্গে ১৮ জনকে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধদের ধরে এনে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যমতে, এটি মুক্তাগাছায় একদিনে সংঘটিত সবচেয়ে বড় গণহত্যা।

 

গৃহবধূ নূর বানুর পরিবারের সাতজন শহীদ হন। তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হন, তবে তিন সন্তানকে নিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে প্রাণে বাঁচেন। বলবাড়িতে নারী-শিশুদের একত্র করে গুলি চালানো হয়, সেদিন তিন শিশুসহ ১৭ নারী শহীদ হন। প্রত্যক্ষদর্শী জবান আলী জানান, গুলির পর লাশের নাড়িভুঁড়ি গাছের ডালে ঝুলে ছিল।  

 

কাতলসা গ্রামে রাজাকার করিম মুন্সির সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা ২৮ জনকে ধরে নিয়ে কৈয়ার বিলপাড়ে জড়ো করে। গুলি চালিয়ে হত্যা করে ১৪ জনকে। বাকিদের গণকবরে পুঁতে রাখা হয়। হিন্দু সংখ্যালঘু জীতেন্দ্র প্রসাদ ঠাকুর বাড়ি আক্রমণ করে চারজনকে হত্যা করা হয়।  

 

হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি গ্রামে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাইয়া বিলে আশ্রয় নেওয়া অসংখ্য মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। হাফিজা খাতুন জানান, তার স্বামী কুমেদ আলী সেদিন নিহত হন।  

 

জবান আলী জানান, পাকিস্তানি সেনারা তাকে গুলি করে মৃত ভেবে ফেলে যায়। পরে তিনি চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে যান। অন্যদিকে কাশেম আলী জানান, তার বাবা আজগর আলী ও ভাই উসমানকে ক্ষেতে হালচাষ করার সময় গুলি করে হত্যা করা হয়।  

 

স্থানীয় রাজাকার নঈম উদ্দিন মাস্টার, জবেদ আলী মুন্সি, করিম ফকির, আতিকুর রহমান, আব্দুস সালাম ও নজর আলী ফকির পাকিস্তানি সেনাদের সহায়তা করে। প্রায় ১০০-১৫০ সেনা আটটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে হামলা চালায়।  

 

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও এসব বধ্যভূমিতে শহীদদের নামফলকসহ স্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হয়নি। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, যা করা হয়েছে তা শহীদদের প্রতি অবমাননার শামিল। শহীদ পরিবারের সন্তানদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।  

 

প্রত্যক্ষদর্শী জবান আলী আক্ষেপ করে বলেন, তার পরিবারের সাতজন শহীদ হলেও স্মৃতিস্তম্ভে তাদের নাম নেই। মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম জানান, বিনোদবাড়ি মানকোনে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নারী-শিশু ও সংখ্যালঘুদের হত্যা করা হয়েছিল।  

 

মুক্তিযুদ্ধের গবেষক বিমল পাল বলেন, শহীদদের তালিকা তৈরি ও গণকবর চিহ্নিত করা হলেও এগুলো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। ভাঙাচোরা কাঠামো কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।  

 

স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সেনারা যে বর্বরতা চালিয়েছিল, তা মুক্তাগাছার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ। অথচ আজও সেই বধ্যভূমি অযত্নে পড়ে আছে। শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও স্বীকৃতি প্রদানের দাবি স্থানীয়দের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

সব খবর

আরও পড়ুন

জন্মস্থানে অবহেলিত কিংবদন্তি বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বী

নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন জন্মস্থানে অবহেলিত কিংবদন্তি বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বী

বিজয়ের আগেই কূটনৈতিক কৌশল বদলেছিল ওয়াশিংটন

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনগুলো বিজয়ের আগেই কূটনৈতিক কৌশল বদলেছিল ওয়াশিংটন

কারাগারে দ্বিতীয় বিজয় দিবস কাটাবেন একাত্তরের বিজয়ের কারিগরেরা

‘দেশ স্বাধীন করার শাস্তি’ কারাগারে দ্বিতীয় বিজয় দিবস কাটাবেন একাত্তরের বিজয়ের কারিগরেরা

আজ ৫৫তম মহান বিজয় দিবস

স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা আজ ৫৫তম মহান বিজয় দিবস

রায়েরবাজারে জনসমাগম কম, তবু উচ্চারিত হলো মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস রায়েরবাজারে জনসমাগম কম, তবু উচ্চারিত হলো মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার

প্রণয় ভার্মাকে তলবের পর ঢাকার উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করল নয়াদিল্লি

প্রণয় ভার্মাকে তলবের পর ঢাকার উদ্বেগ প্রত্যাখ্যান করল নয়াদিল্লি

পরাজয় যতই স্পষ্ট, বুদ্ধিজীবী অপহরণের মাত্রা বাড়তে লাগল

একাত্তরের এই দিন | ১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ পরাজয় যতই স্পষ্ট, বুদ্ধিজীবী অপহরণের মাত্রা বাড়তে লাগল

বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহর, ঢাকা দখলের লড়াই তীব্র; দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অগ্রযাত্রা

একাত্তরের এইদিন | ১২ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহর, ঢাকা দখলের লড়াই তীব্র; দেশজুড়ে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অগ্রযাত্রা