সর্বশেষ

সংস্কারের হাল-হকিকত

২০৮ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র তিনটি: জনপ্রশাসন সংস্কার আটকে কোথায়?

প্রকাশিত: ৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:৩১
২০৮ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র তিনটি: জনপ্রশাসন সংস্কার আটকে কোথায়?

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার নামে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই ধারাবাহিকতায় জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্যও গঠিত হয় একটি কমিশন, যা দীর্ঘ পর্যালোচনা, পরামর্শ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ২০৮টি সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দেয়। কিন্তু কয়েক মাস পার হয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র তিনটি। ফলে প্রশ্ন উঠছে—বাকি সুপারিশগুলোতে দেরি হচ্ছে কেন? এবং এই বিলম্ব প্রশাসনের দক্ষতা ও স্বচ্ছতায় কী প্রভাব ফেলছে?

 

কমিশনের মোট ২০৮ সুপারিশের মধ্যে প্রথমে ১৮টিকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সভায় এর মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত সহজে বাস্তবায়নযোগ্য আটটি প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাস্তবে কার্যকর হয়েছে মাত্র তিনটি—

  • মহাসড়কের ফিলিং স্টেশনে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নিশ্চিত
  • নাগরিকের পাসপোর্ট পাওয়ার মৌলিক অধিকার
  • সব সরকারি দপ্তরে নির্দিষ্ট বিরতিতে গণশুনানি আয়োজন

কমিশনের সদস্যদের মতে, এগুলোর ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ খুব দ্রুত নেওয়া যেত। কিন্তু প্রশাসনের জটিল সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক উদ্যোগের ঘাটতি এবং কাগুজে প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ার কারণে বাস্তবায়ন থমকে আছে।

 

২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর জনমুখী, জবাবদিহিমূলক, নিরপেক্ষ ও দক্ষ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা গড়ার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন সুপারিশ জমা দেয় ২০২৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। এরপর ১৬ জুন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৮টি প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

প্রাধান্য পাওয়া আটটি প্রস্তাব ছিল—

  • সরকারি ওয়েবসাইটগুলোকে ডায়নামিক ও হালনাগাদ করা
  • কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি গঠন
  • কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা
  • গণশুনানি বাধ্যতামূলক করা
  • তথ্য অধিকার আইনের কার্যকর প্রয়োগ
  • বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পুনর্গঠন
  • ডিজিটাল রূপান্তর ও ই-সেবা সম্প্রসারণ

কিন্তু বাস্তবে এই সব প্রস্তাবই এখনও ফাইল ঘুরে বেড়াচ্ছে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মধ্যে।

যেসব বড় সুপারিশ এখনও আটকে

  • স্থায়ী জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন
  • ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস সংস্কার
  • উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করা
  • কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদোন্নতি না হলে বেতন সুবিধা
  • স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন
  • বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পুনর্গঠন

এসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রশাসনিক দুর্নীতি কমত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাস পেত, এবং সেবাপ্রদান দ্রুত হতো—এমনই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক মুহম্মদ মফিজুর রহমান মনে করেন—জনপ্রশাসন সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে ভবিষ্যৎ সরকার একই পুরনো প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করবে।
 

তার ভাষায়, “এই সুপারিশগুলো অপকারে নয়, জনগণের উপকারেই আসবে। কিন্তু এগুলো দুর্বলভাবে উপস্থাপিত এবং বাস্তবায়নে ইচ্ছাশক্তির অভাব পরিষ্কার।”

 

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, “আমরা কাজ শেষ করেছি সময়মতো। কিন্তু বাস্তবায়নে বিলম্ব হলে অন্যান্য খাতেও বাধা সৃষ্টি হবে।”

 

ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “জনপ্রশাসনের জটিলতা চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সমাধানে সরকার দৃঢ় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি—এটাই হতাশার বিষয়।”

 

সচিবালয়ের নন-গেজেটেড কর্মচারীরা বলছেন—সংস্কারের কথা বলা হলেও নিচের স্তরের কর্মচারীদের কোনো সুবিধা বা পদোন্নতি কাঠামো উন্নত হয়নি। তারা অভিযোগ করেন, বিগত ৫৩ বছরে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও নিচের পর্যায়ের কর্মচারীরা বঞ্চিতই রয়ে গেছেন।

 

স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য বহু কমিশন গঠন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সময়কার ‘সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি’, জিয়াউর রহমানের ‘পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন’, এরশাদের ১০টি সংস্কার কমিশন, বিএনপি-আওয়ামী লীগ সরকার ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ মিলিয়ে প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে বাস্তবায়িত সুপারিশের সংখ্যা অতি সামান্য।

 

সাবেক সচিব এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার মনে করেন, এই সংস্কারগুলো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বাস্তবায়নই হয় না। তার ভাষায়,
“এটি রাজনৈতিক সরকারের জন্য রেখে দেওয়াই উত্তম। কারণ গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া কোনো সংস্কার টেকসই হয় না।”

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব এম রায়হান আখতার বলেন, “দুই মাস প্রশিক্ষণে ছিলাম, রোববার থেকে কাজ শুরু করব।”
 

তিনি আরও জানান, সংস্কার কার্যক্রম চলমান এবং কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে।

সব খবর

আরও পড়ুন

ভারতের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব

হিন্দুস্থান টাইমসে হর্ষবর্ধন শ্রীংলার কলাম ভারতের দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে: রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না ভারত

দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্ধৃতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না ভারত

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি ১৬ নাগরিক সংগঠনের

আইন-শৃঙ্খলার অবনতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি ১৬ নাগরিক সংগঠনের

বিশ্বশান্তির ছয় সারথীর মরদেহ আসছে শনিবার

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হবে বিশ্বশান্তির ছয় সারথীর মরদেহ আসছে শনিবার

বাংলাদেশে নীরবে চলছে সংখ্যালঘু নিধন

শ্রীলংকা গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বাংলাদেশে নীরবে চলছে সংখ্যালঘু নিধন

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে জরুরী তলব

নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে জরুরী তলব

‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনো পরাজিত শক্তি বদলাতে পারবে না’

বিজয় দিবসে স্মৃতিসৌধে মানুষের দৃঢ় প্রত্যয় ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনো পরাজিত শক্তি বদলাতে পারবে না’

বাংলাদেশ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে

শ্রীলংকা গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণ বাংলাদেশ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে