বিজয়ের প্রাক্কালে ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১। একদিকে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর ঢাকামুখী অভিযান গতি পাচ্ছিল, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলছিল তীব্র টানাপোড়েন। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনী ক্রমশ প্রতিরোধ হারাচ্ছিল; একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র–সোভিয়েত–চীনকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক কূটনৈতিক মঞ্চে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
ওয়াশিংটনে উৎকণ্ঠা: নিক্সন–কিসিঞ্জারের টানটান সময়
১২ ডিসেম্বর সকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে অপেক্ষায় ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্তার জন্য। ভারতকে ‘নিশ্চল যুদ্ধবিরতি’তে রাজি করাতে ১০ ডিসেম্বর মস্কোতে পাঠানো মার্কিন বার্তার জবাব তখনও আসেনি। কিসিঞ্জারের ভাষায়, ফোনে সোভিয়েত কর্মকর্তারা শুধু জানিয়েছেন ভারতের পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা নেই, কিন্তু মূল প্রশ্নের উত্তর দেননি।

চাপ বাড়াতে বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের দিকে নিক্সন প্রশাসন হটলাইনে আরেকটি কঠোর বার্তা পাঠায় যা নিক্সন যুগে প্রথম হটলাইন ব্যবহার। এর সমান্তরালে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি জোরদারের সিদ্ধান্ত হয়। পারমাণবিক শক্তিচালিত মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ও এর বহর ১০ ডিসেম্বর ভিয়েতনাম উপকূল থেকে রওনা দিয়েছিল। ১২ ডিসেম্বর মালাক্কা প্রণালি পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে এগোনোর অনুমতি পায়। উদ্দেশ্য হিসেবে জানানো হয় ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার।
মার্কিন পদক্ষেপে সাড়া দিয়ে সোভিয়েত নৌবহরও ভারত মহাসাগরের দিকে যাত্রা শুরু করে, আর চীনকে বার্তা পাঠিয়ে নিক্সন জানান—সোভিয়েত যদি চীনের ওপর চড়াও হয়, যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
ঢাকা দখলের লড়াই: ভৈরব–নরসিংদীতে অগ্রযাত্রা
মুক্তি ও মিত্রবাহিনী ঢাকার চারপাশে চাপ ক্রমেই বাড়াতে থাকে। ‘অপারেশন ঢাকা’ নামে ১২ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ভৈরব–নরসিংদী–ময়মনসিংহ রুটে অগ্রযাত্রা জোরদার করে। ভোরে ভারতীয় বিমানবাহিনী ভৈরবের পাকিস্তানি ঘাঁটি বোমা বর্ষণ করে। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ স্টেডিয়ামে নামা হেলিকপ্টারে ভারতীয় ১০ বিহার রেজিমেন্টকে নরসিংদীতে এগিয়ে নেওয়া হয়।

মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম তাঁর স্মৃতিতে লিখেছেন, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেদিন নৌকায় মেঘনা পার হয় পাকিস্তানি কামান গোলার মুখে, এরপর রেললাইন ধরে নরসিংদী রেলস্টেশনের দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে ভারতীয়রা পৌঁছে গিয়েছিল আগেই।
পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন শহরে প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও অধিকাংশ ইউনিট বিচ্ছিন্ন ও মনোবলহীন হয়ে পড়ছিল।
ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যার প্রস্তুতি
এদিন ঢাকায় চলছিল এক অন্য ভয়াবহ প্রস্তুতি। ক্যান্টনমেন্টে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আলবদর–আলশামস নেতাদের ডেকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তুলে দেন। সেই নির্দেশে পুরান ঢাকার কলতাবাজার থেকে পিপিআই-এর জেনারেল ম্যানেজার ও বিবিসি সাংবাদিক নিজামউদ্দিন আহমেদকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায় যা পরবর্তী গণহত্যার অন্যতম পূর্বপ্রস্তুতি।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ ও মুক্তাঞ্চলের বিস্তার
দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিবাহিনী চূড়ান্ত অভিযান জোরদার করে।
কলকাতা–ভারতে বাংলাদেশ দিবস
১২ ডিসেম্বর কলকাতায় রাজ্য কংগ্রেসের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালিত হয়। শোভাযাত্রায় জয়বাংলা স্লোগান ও বাংলাদেশের পতাকা শোভা পায়। গীতা মন্দির স্কুলে আয়োজিত জনসভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের আইনজীবী ও এমএলএ সালাউদ্দিন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া