মহান বিজয় দিবসে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ মানুষের এক আবেগঘন মিলনমেলা। দিনভর নানা কর্মসূচি ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে ৫৪তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছে সর্বস্তরের মানুষ। রাজনৈতিক বিতর্ক ও ইতিহাস বিকৃতির নানা প্রচেষ্টা উপেক্ষা করেই স্মৃতিসৌধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি স্পষ্ট করে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কোনো পরাজিত শক্তিই পাল্টে দিতে পারবে না।
মঙ্গলবার ভোরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সকাল সাড়ে সাতটার পর স্মৃতিসৌধ উন্মুক্ত হলে মানুষের ঢল নামে।
রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে আসা পরিবার, শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণে স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ লাল-সবুজের রঙে রূপ নেয়। কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার হাতে ফুল, মুখে দেশাত্মবোধক গান আর স্লোগানে মুখর ছিল পুরো এলাকা।
স্মৃতিসৌধে সন্তানদের নিয়ে আসা অনেক অভিভাবকই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ববোধের কথা জানান। ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ বলেন, “বিজয় কী জিনিস, সেটাই দেখাতে সন্তানদের নিয়ে এসেছি। আমরা স্বাধীন না হলে বাঙালি হিসেবেই পরিচিত হতাম না।” তার মতে, ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক তুলে স্বাধীনতাকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
ঢাকা থেকে স্মৃতিসৌধে আসা মোবারক বলেন, “১৯৭১ সালে কীভাবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই গৌরবগাঁথা জানাতেই সন্তানদের নিয়ে এসেছি।” তার ভাষায়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তোলারা পরাজিত শক্তি, তাদের কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান লক্ষ্য করা গেছে। কলেজপড়ুয়া মোস্তাফিজুর রহমান সাব্বির বলেন, “৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগে এই দেশ। স্বাধীনতা নিয়ে অপপ্রচার হলে কষ্ট লাগে। নতুন প্রজন্ম ইতিহাস জানে, সব কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।”
দিনভর স্মৃতিসৌধে উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। এক নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা শেখ রুহুল আমিন বলেন, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সংকটে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আবারও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও রাজনৈতিক নেতারাও মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। তারা মনে করেন, স্বাধীনতার ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ হলে গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথও বাধাগ্রস্ত হবে।
সব বিতর্ক ও আক্ষেপের মধ্যেও জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ের চেতনা এখনো জনগণের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত। এই দিনটি শুধু স্মৃতিচারণ নয়, বরং ভবিষ্যতের অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতীক।