১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল প্রায় নিশ্চিত বাস্তবতা। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্বিবেচনা শুরু করে। ইসলামাবাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে পাঠানো গোপন টেলিগ্রামে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ অনিবার্য এবং যুক্তরাষ্ট্রকে সেই বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের পরিস্থিতি বিবেচনায় মার্কিন দূতাবাস ওয়াশিংটনকে জানায়, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মৌলিক শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে। তাই প্রশ্ন থাকবে না ‘স্বীকৃতি দেয়া হবে কি না’, বরং ‘কবে দেয়া হবে’। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সুবিধা, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক—সবকিছু বিবেচনায় রেখে সময় নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়।
দূতাবাসের মূল্যায়নে বলা হয়, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া দেশগুলোকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করবে, এমনকি কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকিও দিতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে তারা এই অবস্থান ধরে রাখতে পারবে না, কারণ এতে তারা দাতা দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, পশ্চিমা কয়েকটি দেশ আগে স্বীকৃতি দিলে পরে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ককে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশকে দ্রুত স্বীকৃতি দিলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিপরীতে দেরি করলে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের স্বীকৃতিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি দরকষাকষির উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার করার চিন্তা ছিল মার্কিন কর্মকর্তাদের।
দূতাবাস সতর্ক করে দেয়, অযথা দেরি করলে বাঙালিরা সেটিকে আরেকটি অপমান হিসেবে দেখবে। এতে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেটের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, এমনকি বহিষ্কারের চাপও তৈরি হতে পারে। তাই দ্রুত স্বীকৃতি দিয়ে বাঙালিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তৈরি হওয়া নেতিবাচক ধারণা দূর করার সুযোগ রয়েছে।
মার্কিন দূতাবাস মনে করে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ভূখণ্ডটি সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত গুরুত্ব না রাখলেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। একই সঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বিপুল মানবিক সহায়তার প্রয়োজন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ সেই ক্ষত সারাতে সহায়ক হবে এবং নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করবে।
নথিতে বলা হয়, যুদ্ধ শেষ হলে আন্তর্জাতিক ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হবে। যুক্তরাষ্ট্রও এতে অংশ নিতে চাইবে। এতে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত হবে এবং পূর্বে তৈরি হওয়া মানসিক ক্ষত কিছুটা সারানো সম্ভব হবে।
দূতাবাসের পরামর্শ ছিল, বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখা এবং সম্প্রসারণ করা। তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশকে আন্তরিকভাবে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী। একই সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরা হয়।