দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের পরিবর্তে ক্রমবর্ধমান মানবাধিকার লঙ্ঘন, উগ্র ইসলামপন্থার উত্থান এবং অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে নিমজ্জিত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বিশিষ্ট কৌশলবিদ ও লেখক ব্রহ্মা চেল্লানি। তিনি দিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এর এমেরিটাস অধ্যাপক এবং বার্লিনের রবার্ট বশ একাডেমির ফেলো।
চেল্লানি বৈশ্বিক গণমাধ্যম সংস্থা প্রজেক্ট সিন্ডিকেট-এ প্রকাশিত মতামত প্রবন্ধে লিখেছেন, অনেকেই ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার অপসারণে গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হবে। কিন্তু বাস্তবে সামরিকবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশ আরও বিশৃঙ্খলার দিকে যাচ্ছে। নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস সরকার প্রধানের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনী ও ইসলামপন্থীদের হাতে।
সেনাবাহিনী ও ইসলামপন্থীদের ভূমিকা
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনকে কেবল ছাত্রনেতৃত্বাধীন গণআন্দোলনের ফল হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও আসলে সেনাবাহিনীই মূল ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি উগ্র ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো আন্দোলনে পেশিশক্তি জুগিয়েছে।
ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক সংস্কার ও নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও একের পর এক নির্বাচন স্থগিত হচ্ছে। সংবিধানবহির্ভূত এ সরকার ইতোমধ্যেই বিচার বিভাগে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করেছে, প্রধান বিচারপতি ও পাঁচজন সিনিয়র বিচারপতিকে অপসারণ করেছে এবং বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দমননীতি
চেল্লানির মতে, সরকারের সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা। হাজার হাজার মানুষ – বিশেষ করে শেখ হাসিনার সমর্থক আইনজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীরা – গ্রেপ্তার হচ্ছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা বা অপহরণের মামলা দেওয়া হচ্ছে। কারাগারে নির্যাতন, এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগও বাড়ছে।
উগ্রবাদের পুনরুত্থান
সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হলো উগ্র ইসলামপন্থী শক্তির পুনরুত্থান। পূর্বে নিষিদ্ধ জিহাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে, কুখ্যাত নেতাদের মুক্তি দিয়ে কাউকে কাউকে সরকারী পদে বসানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেমন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী এবং ইসলামপন্থীদের চোখে “ভ্রান্ত” মুসলিম গোষ্ঠীগুলো হামলার শিকার হচ্ছে। নারীদের পোশাক ও চলাফেরার ওপর তালেবান-ধাঁচের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামপন্থী ঝোঁকের বিএনপিও বর্তমান পরিস্থিতিকে “ধর্মের নামে উন্মাদনা” ও “ভয়াবহ সহিংসতা” বলে সমালোচনা করেছে।
অর্থনৈতিক মন্দা
প্রবন্ধে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একসময়ের শক্তিশালী অর্থনীতি এখন টালমাটাল। জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে, বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে, এবং মুদ্রাস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে, কর্মসংস্থান সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি সমাজে ক্ষোভ ও উগ্রপন্থা বৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করছে।
আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব
এই সংকটের প্রভাব শুধু বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিবেশী ভারত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ দেশটির তিন দিক ঘিরে বাংলাদেশ সীমান্ত। শেখ হাসিনার আমলে ভারত-বাংলাদেশ পারস্পারিক ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও বাণিজ্য সহযোগিতায় ছিল। তার পতনে সেই সম্পর্ক দুর্বল হয়েছে, ফলে ভারতকে সীমান্তে কড়া নজরদারি বাড়াতে হচ্ছে।
চেল্লানি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকেও সমালোচনা করেছেন। তার মতে, ওয়াশিংটন হাসিনার পতনকে স্বাগত জানালেও এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে জটিল করে তুলছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার নতুন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মহলের করণীয়
চেল্লানি সতর্ক করেছেন, যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত পদক্ষেপ না নেয়, তবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো এক সামরিকবাহিনী সমর্থিত ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। গণতন্ত্র, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে নীরব দর্শক না থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।