মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দুদিন পর, ১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল অসংখ্য মরদেহের ভিড়ে এক কিংবদন্তি চিকিৎসকের দেহ। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফজলে রাব্বী। পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর বাহিনী তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করা। অথচ বিজয়ের ৫৪ বছর পরও নিজ জন্মভূমি পাবনায় তার নামে নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন।
১৮ ডিসেম্বর রায়েরবাজারে পাওয়া তার মরদেহে ছিল অজস্র বুলেটের চিহ্ন। দুই চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছিল। শরীরজুড়ে বেয়নেটের আঘাত, হাত বাঁধা, হৃদপিণ্ড ও কলিজা ছিঁড়ে ফেলা—এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডে স্তম্ভিত হয়েছিল গোটা জাতি। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে আলবদর বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করা।
১৯৩২ সালে পাবনার হেমায়েতপুরের ছাতিয়ানীতে জন্ম নেওয়া ফজলে রাব্বী ছিলেন অসাধারণ মেধাবী। পাবনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন শীর্ষস্থান অর্জন করে। ১৯৬২ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান থেকে এমআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন একসঙ্গে দুটি বিষয়ে, ইন্টারনাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজি। এ রেকর্ড আজও অটুট।
মাত্র ৩২ বছর বয়সে তার গবেষণা আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ১৯৭০ সালে ব্রিটিশ জার্নাল অব দ্য ডিসিস অব চেস্ট ও ল্যান্সেটে প্রকাশিত গবেষণা তাকে বিশ্বখ্যাত করে তোলে। পাকিস্তান সরকার তাকে সেরা অধ্যাপক পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছিল। কিন্তু বাংলার মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তিনি সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন, ওষুধ ও অর্থ সহায়তা করেছেন। নিজের গাড়ি ব্যবহার করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে। তার স্ত্রী ডা. জাহানারা রাব্বীও মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ছিলেন। ঝুঁকি জেনেও তিনি মানবিক দায়িত্ব থেকে সরে আসেননি।
১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর রাতে স্ত্রী জাহানারা রাব্বী স্বপ্নে দেখেছিলেন কবরের দৃশ্য। ১৫ ডিসেম্বর সকালে তিনি স্বামীকে বললে ফজলে রাব্বী হেসে উত্তর দেন, “তুমি বোধহয় আমার কবর দেখেছো।” সেদিন বিকালে পাকিস্তানি সেনারা তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। দুদিন পর তার মরদেহ পাওয়া যায় রায়েরবাজারে।
ঢাকায় তার নামে একটি পার্ক ও মেডিক্যাল কলেজের হল থাকলেও পাবনায় নেই কোনও প্রতিষ্ঠান বা স্মৃতিচিহ্ন। ২০০৮ সাল থেকে ‘শহীদ ডা. ফজলে রাব্বী স্মৃতি পরিষদ’ পাবনা মেডিক্যাল কলেজ তার নামে নামকরণের দাবি জানিয়ে আসছে। সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন হলেও বাস্তবায়ন হয়নি।
চাচাতো ভাই সাইদ হাসান দারা বলেন, “ডা. ফজলে রাব্বীর স্মৃতি ধরে রাখতে পরিবার ও স্বজনরা নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক অসহযোগিতার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।” পাবনা জেলা জাসদের সভাপতি মো. আমিরুর ইসলাম রাঙা বলেন, “এমন একজন বিশ্বমানের চিকিৎসকের স্মৃতি সংরক্ষণ করা আমাদের নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়।”
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. ফজলে রাব্বী ছিলেন বিশ্বখ্যাত চিকিৎসক, গবেষক ও মানবিক মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অবদান ছিল অনন্য। কিন্তু জন্মস্থানে আজও নেই কোনও স্মৃতিচিহ্ন। নতুন প্রজন্মের কাছে তার দেশপ্রেম ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।