বিশ্ববাজারে গমের দাম তিন বছর ধরে টানা কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব ঠিকভাবে পড়েনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে প্যাকেট আটার দাম বেড়েছে। অতিরিক্ত দামের চাপ পড়ছে মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর। ব্যবসায়ীরা যুক্তি দিচ্ছেন ডলারদর ও পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির। তবে বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় না করে কেউ অতি মুনাফা করছে কিনা—তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
২০২২ সালে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে গমের দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ১৬ মে প্রতি টনে গমের দাম সর্বোচ্চ ৪৫৭ ডলার স্পর্শ করে। এরপর বিশ্ববাজারে মূল্য কমতে থাকে। একই বছরের অক্টোবরেই প্রতি টন ৩৩৫ ডলারে নেমে আসে। চলতি বছরের ২০ অক্টোবর দাম আরও কমে দাঁড়িয়েছে ২১৮ ডলারে। অর্থাৎ তিন বছরে বিশ্ববাজারে গমের দর প্রায় অর্ধেক নেমে এসেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে সেই সুবিধা এখনো ভোক্তা পাচ্ছে না। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—২০২২ সালের ২০ অক্টোবর দেশে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম ছিল ৫৫-৫৮ টাকা এবং প্যাকেট আটার দাম ৫৮-৬০ টাকা। তিন বছর পরেও খোলা আটার দাম মাত্র ৬-১০ টাকা কমে ৪৫-৫২ টাকায় নেমে এসেছে। কিন্তু প্যাকেট আটার দাম উল্টো বেড়ে এখন ৫৫-৬৫ টাকা। বাজারে দুই কেজির প্যাকেট সাধারণত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, যার গায়ের দাম ছিল ১১০-১১৫ টাকা। এখন তা বেড়ে ১৩০ টাকা। ফলে প্যাকেট আটা এখন মোটা বা গুটি স্বর্ণা চালের দামেরও ওপরে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু বিশ্ববাজারের দরে হিসাব করলে বাস্তব চিত্র বোঝা যায় না। গম আমদানিতে ডলারদর, সমুদ্রভাড়া, পরিবহন, শ্রমিক খরচ, প্যাকেজিং, বিদ্যুৎ–জ্বালানি ব্যয়সহ মোট খরচ বেড়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে প্রতি ডলারের দাম ছিল ১০৬ টাকার মতো। এখন প্রায় ১২২ টাকা। ফলে ডলারের ওপর নির্ভর আমদানি ব্যয় বাড়ছে।
কিন্তু হিসাব বলছে ভিন্ন কথা। ২০২২ সালে প্রতি টনে গমের মূল্য ছিল ৩৩৫ ডলার। সে সময় ডলার ১০৬ টাকা ধরলে মোট দাম দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৫১০ টাকা। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম ২১৮ ডলার এবং ডলার ১২২ টাকা ধরলে প্রতি টনে দাম দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৫৯৬ টাকা। অর্থাৎ ডলারদর বাড়লেও তিন বছর আগের তুলনায় এখন প্রতি টনে প্রায় ৯ হাজার টাকা কমে আমদানি করা যাচ্ছে। ফলে বাজারে দাম না কমার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
বাংলাদেশে বছরে গমের চাহিদা ৭০-৮০ লাখ টন। উৎপাদন হয় মাত্র ১২-১৩ লাখ টন। বাকি অংশ আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, গম আমদানিতে কোনো শুল্ক নেই। গত অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে ৬২ লাখ ৩৫ হাজার টন। চলতি অর্থবছরেও ইতোমধ্যে আমদানি হয়েছে ১১ লাখ টনের বেশি। তবে কিছু বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এক-দেড় বছর ধরে আমদানি সীমিত করেছে, ফলে সরবরাহে চাপ তৈরি হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বসুন্ধরা মাল্টি ফুড অ্যান্ড বেভারেজের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের প্রধান রেদওয়ানুর রহমান বলেন, “২০২২ সালের তুলনায় বর্তমানে গমের দাম অনেক কম হলেও ডলারের দাম ৭০ শতাংশ বেড়েছে। বড় আমদানিকারক কিছু কোম্পানি নানা কারণে আমদানি বন্ধ রেখেছে। ফলে বাজারে সরবরাহ কম থাকায় দাম কমার সুযোগ পাচ্ছে না।”
এদিকে আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, মূল্য নির্ধারণে শুধু আন্তর্জাতিক দর ধরা যায় না। গমের মান ও প্রোটিনের মাত্রা যত বেশি, দামও তত বেশি হয়। এ ছাড়া এফওবি মূল্য ছাড়াও অন্তত ৫০ ডলার পর্যন্ত সমুদ্র পরিবহন খরচ যুক্ত হয়।
তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, অযৌক্তিকভাবে দাম ধরে রাখা হয়েছে। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, “যুদ্ধের সময় বিশ্ববাজারে দাম বাড়তেই ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়িয়েছে। এখন দাম কমলেও বাজার কমছে না। অনেক খাদ্যপণ্যে দাম না কমিয়ে পরিমাণ কমিয়েছে কোম্পানিগুলো। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও ঠকছেন ভোক্তা।”
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, “প্রতিষ্ঠানগুলো কত দরে আমদানি করছে, কত শুল্ক-কর দিচ্ছে—এসব বিবেচনায় নিয়ে ট্যারিফ কমিশনের খতিয়ে দেখা উচিত। আটা অত্যাবশ্যক পণ্য। কেউ অতি মুনাফা করছে কিনা তা তদন্ত প্রয়োজন।”
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফারুক আহম্মেদ বলেন, “আমদানি মূল্য, শুল্কহার ও স্থানীয় বাজারে দাম—এসব বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেখে। আইনের সীমাবদ্ধতা থাকলেও বাজার তদারকি করা হবে।”
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্ববাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয় না হলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত হয়, ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং অতি মুনাফার সুযোগ তৈরি হয়। জরুরি পণ্য হিসেবে আটার দামে স্বচ্ছতা ও সরকারি নজরদারি বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।