বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের অষ্টম দিন। স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পূর্বাঞ্চল থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম কর্মকৌশল—সব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অভূতপূর্ব অগ্রযাত্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা। একের পর এক জেলা হানাদারমুক্ত হয়, ভেঙে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর যোগাযোগ, রসদ ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। পুরো দেশজুড়ে বিজয়ের লাল-সবুজ ছায়া স্পষ্ট হতে থাকে।
পূর্বাঞ্চলে টানা অগ্রযাত্রা: কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্বাধীন
৮ ডিসেম্বর সকালেই জানা যায় কুমিল্লা শহর পাকিস্তানি দখলমুক্ত। ভারতীয় শিখ জাট ব্যাটালিয়ন এবং মুক্তিবাহিনীর আইনউদ্দিন-দিদারুল আলমদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লায় প্রবেশ করেন। হানাদাররা পালিয়ে গেলে টাউন হলে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। পরে লে. জেনারেল অরোরা কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে স্থানীয় মানুষ হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান।
একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়াও মুক্ত হয়। ভারতীয় ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত অগ্রযাত্রায় প্রায় বিনা প্রতিরোধে শহরটি হানাদারমুক্ত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আশুগঞ্জের দিকে অগ্রসর হন, যেখানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ভারতীয় বাহিনীর কয়েকটি কলাম পাকিস্তানি বাহিনীকে তিনদিকে ঘিরে ফেলে।
দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে যশোর, সাতক্ষীরা, মাগুরা মুক্ত
যশোর থেকে যৌথ বাহিনী তিনদিকে অভিযান চালায়। একদল ঝিনাইদহ হয়ে মাগুরা মুক্ত করে, যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ রেলসংযোগ মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে। ধাওয়া খেয়ে পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে ফরিদপুরের দিকে সরে যায়।
অন্য একদল সাতক্ষীরা ও কলারোয়া দখল করে। খুলনার পথে লেবুতলা যৌথ বাহিনীর দখলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে ঝিনাইদহের কাছে একটি সেতু ধ্বংস করায় অগ্রযাত্রা সাময়িক ব্যাহত হলেও বিজয়ধারা থামেনি। বরিশাল ও পিরোজপুরও এদিন হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলে শহরজুড়ে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তর-পশ্চিমে রংপুরের পতন ঘনিয়ে আসে
রংপুর শহরের পতন ছিল সময়ের অপেক্ষা। পীরগঞ্জ মুক্ত হয় এবং সৈয়দপুরের উত্তরে পাকিস্তানি একটি ঘাঁটি যৌথ বাহিনীর দখলে আসে। প্রায় সব রণাঙ্গনেই পাকিস্তানি বাহিনী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ঢাকার দিকে তিন কলামের অগ্রগতি
সকালে পূর্ব রণাঙ্গনের সামরিক বিশ্লেষণে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বুঝতে পারে পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সিলেট, ময়নামতি, হিলি, জামালপুর, চট্টগ্রাম—প্রতিটি অঞ্চলে পাকিস্তানি ইউনিট কার্যত ফাঁদে আটকা। ঢাকার দিকে পিছু হটা অসম্ভব হওয়ায় তাদের পরাজয় শুধু সময়ের অপেক্ষায়।
মিত্রবাহিনী তাই তিনটি সিদ্ধান্ত নেয়:
১. পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান
২. জেনারেল অরোরার নেতৃত্বে তিন কলামের ঢাকা অভিযান
৩. হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ রুটে চূড়ান্ত অগ্রগতি
মানেকশ’র আত্মসমর্পণের আহ্বান
৮ ডিসেম্বর আকাশবাণীতে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল এস.এইচ.এফ.জে মানেকশ আবারও পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন,“তোমাদের বিমানবাহিনী অকেজো, সমুদ্রপথ বন্ধ, রসদ নেই, পালানোর পথ নেই। আত্মসমর্পণই একমাত্র উপায়। করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী সম্মানজনক আচরণ পাবে।”
এ আহ্বান পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল আরও ভেঙে দেয়।
মুজিবনগর সরকারের প্রতিক্রিয়া: “স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত সত্য”
এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন,“স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজয় কেবল সময়ের অপেক্ষা।”
তিনি সবাইকে শেষ আঘাত হানতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোকে “ইতিহাসের মহৎ ভূমিকা” বলে উল্লেখ করেন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অবস্থানকে তিনি “অন্ধতা ও নির্বুদ্ধিতা” বলে মন্তব্য করেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাপ–উদ্বেগ
জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন জানান,“বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য; পাকিস্তানের উচিত শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেওয়া।” উ থান্ট ঢাকায় আটকা পড়া জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের নিরাপদ সরে যেতে সুরক্ষিত করিডর চেয়ে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন।
এদিকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক রওনা দেন। ইয়াহিয়া খান দেশজুড়ে যুদ্ধ তহবিলে অর্থ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জনগণের ওপর নতুন আর্থিক চাপ তৈরি করেন।