ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সময় নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের তথ্যে আগুন লাগার সময় নিয়ে দেখা দিয়েছে ১৫ মিনিটের পার্থক্য, আর ফায়ার সার্ভিসের দেরিতে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
শনিবার (১৮ অক্টোবর) দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট কাজ করে সাত ঘণ্টা পর রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা দেয়। তবে ওই সময়ও কিছু জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগুন লেগেছে দুপুর ২টা ১৫ মিনিটে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, তারা খবর পেয়েছে ২টা ৩০ মিনিটে এবং প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে ২টা ৫০ মিনিটে অর্থাৎ আগুন লাগার অন্তত ৩৫ মিনিট পর। এ সময়ের ব্যবধান নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন কার্গো কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের ক্ষোভ ও অভিযোগ
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলেন, “২টার দিকে আগুন লাগে। শ্রমিক ও আনসার সদস্যরা তখনও ভেতরে ছিল। আগুন লাগার পর লোকজন নেভাতে এগিয়ে গেলে বলা হয়, গুদামে বিস্ফোরক ও কেমিকেল আছে, সবাই সরে যান।”
তিনি অভিযোগ করেন, “ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ৮ নম্বর গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারেনি।”
ইমরান হোসেন নামে এক সিঅ্যান্ডএফ পরিচালক বলেন, “আগুন প্রথমে কুরিয়ার গুদামে লাগে, বিশেষ করে ডিএইচএলের খাঁচায়। সেখানে ২৫–৩০টি কুরিয়ার সার্ভিসের পৃথক ঘর বা কিউবিকল আছে। শুরুতে কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কারণ মূল্যবান পণ্য ও নিরাপত্তার বিষয় ছিল।”
ফায়ার সার্ভিস ও মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানান, “আমরা ১৪টা ৩০ মিনিটে খবর পাই এবং সঙ্গে সঙ্গে মুভ করি। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হওয়ায় ঢোকার আগে কিছু নিরাপত্তা যাচাই প্রয়োজন।”
তবে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগ বিষয়ে তিনি বলেন, “এরকম কিছু আমি শুনিনি। তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে।”
অন্যদিকে, বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “ফায়ার সার্ভিসকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়নি। অভিযোগ পাওয়া গেলে খতিয়ে দেখা হবে।”
আগুন নিয়ন্ত্রণ ও ফ্লাইট চলাচল
সন্ধ্যা পর্যন্ত ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকে। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রানওয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়, ফলে এক ডজনেরও বেশি ফ্লাইট চট্টগ্রাম, সিলেট ও কলকাতায় অবতরণ করে।
রাত ৯টা ৬ মিনিটে প্রথম ফ্লাইট ছাড়ার অনুমতি দেয় শাহজালাল কর্তৃপক্ষ। এরপর ধীরে ধীরে নিয়মিত ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও আনসার সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেন। কর্তৃপক্ষ জানায়, এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি, তবে অন্তত ২৫ জন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন।
আগুনের উৎস নিয়ে ধোঁয়াশা
প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, স্কাই ক্যাপিটাল এয়ারলাইন্সের গুদাম থেকে আগুন শুরু হয়ে ডিএইচএল কুরিয়ার অংশে ছড়িয়ে পড়ে, পরে তা বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম ‘ডেঞ্জারাস গুডস’-এ পৌঁছায়। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও জানাতে পারেনি কেউ।
সংশ্লিষ্ট কর্মীরা বলছেন, “গুদামে অসংখ্য ক্যামেরা রয়েছে। সেগুলোর ফুটেজ বিশ্লেষণ করলে আগুন লাগার সঠিক সময় ও কারণ জানা যাবে।”
বিমানবন্দরের এই কার্গো ভিলেজে সাধারণত আমদানি করা পণ্য মজুত থাকে। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন কর্মী সংখ্যা ছিল সীমিত। ফলে আগুন লাগার সময় দ্রুত নেভানোর উদ্যোগ নেওয়া যায়নি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো জোনে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার এমন বিলম্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুতর ঘাটতি নির্দেশ করে। তদন্তে যদি দেরি বা অনুমতিজনিত জটিলতা প্রমাণিত হয়, তাহলে এটি বড় প্রশাসনিক ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হবে।