হে বঙ্গবাসী, শুনো এক মহাসনদের কাহিনি যেখানে রাষ্ট্র দেউলিয়া, জনগণ ক্ষুধার্ত অথচ উচ্চ মহলে চলিতেছে ‘জুলাই সনদ’ নামক বিলাসবহুল উৎসব। এই সনদ যেন এক অলৌকিক চুক্তিপত্র, যেখানে ব্যর্থতা ঢাকিয়া দেওয়া হয় শব্দের ঝলকানিতে আর জনগণের কান্না হয় ‘গণতান্ত্রিক ঐকমত্য’।
দেশের অর্থনীতি এখন ICU-নিদ্রাময় কিন্তু সুশীল সমাজের কনফারেন্স রুমে চলিতেছে ‘সংস্কার কমিশনের’ চা-চক্র। কর্মসংস্থান বন্ধ, রপ্তানি খাত ধুঁকিতেছে, বিদেশি বিনিয়োগে চরা, জ্বালানি নাই, উৎপাদন বন্ধ তবু সনদের পাতায় লেখা, “আমরা আগাইতেছি দূর্বার গতিতে।” কিন্তু কোথায় যাইতেছি? সম্ভবত ইতিহাসের ব্যর্থতম রাষ্ট্রের দিকে আমাদের গন্তব্য।
এই জুলাই সনদ যেন এক ধরনের রাষ্ট্রীয় কসমেটিক যেখানে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতি, খেলাপি ঋণ, শ্রমবাজারে নিষেধাজ্ঞা সবকিছুকে মেকআপ দিয়া ঢাকিয়া দেওয়া হয়। জনগণ যখন চালের দাম দেখিয়া হৃদরোগে আক্রান্ত, তখন সনদের পাতায় রচিত হয়, “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জিত হইয়াছে।”
রাজনীতির মাঠে এখন মৌলবাদের ঝান্ডা উড়িতেছে, সহিষ্ণুতা উধাও, সংবিধানকে রাখা হইয়াছে ‘সংস্কারের খসড়া’ হিসাবে। ধর্মের নামে চলিতেছে বিভাজন, অথচ সনদে লেখা, “জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।” এই ঐক্য যেন এক প্রকারের নাট্যশিল্প যেখানে বাস্তবতা নাই, আছে শুধুই অভিনয়।
সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি, যাঁহারা জনগণের দুঃখে কাঁদেন না, কিন্তু সেমিনারে বক্তৃতা দিতে ভালোবাসেন, তাঁহারা এই সনদকে বলিতেছেন “ঐতিহাসিক দলিল।” তাঁহাদের মতে, “এই সনদে বিদ্যমান ভবিষ্যতের রূপরেখা।” অথচ ভবিষ্যতের রাস্তায় এখনো বিদ্যুৎ নাই, পানি নাই, চাকরি নাই, শুধু শূণ্যতার বলিরেখা।
এই সনদে সই করার জন্য চলিতেছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘অতি জরুরি’ বৈঠক। কেউ বলিতেছে, “আমরা সই করব না, যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে।” কেউ বলিতেছে, “আমরা চাই গণভোট।” অথচ জনগণ বলিতেছে, “আমরা চাই ভাত, বিদ্যুৎ, কাজ, চাকরি।” কিন্তু জনগণের কণ্ঠ সনদের শব্দকোষে অনুপস্থিত।
জুলাই সনদ যেন এক খন্ড ‘সুশীলীয় বিলাসিতা’ যেখানে উচ্চ মহলের অর্থ হাতানোর কৌশল লুক্কায়িত আছে। এই সনদ বাস্তবায়নের নামে আসিবে বিদেশি অনুদান, চলিবে প্রকল্প, হইবে বিদেশ সফর আর জনগণ পাইবে ‘আশার আলো’। সেই আলোতে চোখ ঝলসাইয়া যাইবে কিন্তু পেট ভরিবে না।
রাষ্ট্রের দেউলিয়াত্ব এখন আর গোপনীয় নয়, ইহা এক জাতীয় ঐতিহ্য। বাজেটের ঘাটতি, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ, রপ্তানি হ্রাস, শ্রমবাজারে নিষেধাজ্ঞা সবকিছু মিলাইয়া দেশ এখন এক ‘অর্থনৈতিক ট্র্যাজেডি’। অথচ এই ট্র্যাজেডিকে ঢাকিয়া দেওয়া হইতেছে ‘জুলাই সনদ’ নামক রঙিন পর্দায়।
এই সনদ নয়, চাই বাস্তব জবাবদিহি। চাই জনগণের অংশগ্রহণ, চাই সংবিধানের মর্যাদা, চাই সহিষ্ণুতা, চাই কাজ, চাই খাদ্য, চাই নিরাপত্তা। না হলে এই সনদ হইবে শুধুই একটি রাষ্ট্রীয় নাটকের স্ক্রিপ্ট যেখানে জনগণ দর্শক, সরকার অভিনেতা আর বাস্তবতা পর্দার বাইরে।
লেখক: এক ক্লান্ত পেন্সিল - সুশীলের নাটক দেখিতে দেখিতে ত্যাক্ত, বিরক্ত।