ডিসেম্বর এলে বাংলাদেশ আর শুধু একটি ক্যালেন্ডারের পাতা থাকে না। ডিসেম্বর আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে আলপনায়, গানে, বুকের গভীর কোনো অদৃশ্য কুঠুরিতে। এই মাস আমাদের স্মরণ করায়, আমরা কী ছিলাম, কী হতে চেয়েছিলাম, আর আজ কী হয়ে উঠছি। ১৬ ডিসেম্বর তাই কেবল বিজয়ের দিন নয়, এটি এক প্রশ্নের দিন। প্রশ্নটা তরুণদের উদ্দেশে, আবার আমাদের সবার দিকেই ছোঁড়া: এই বাংলাদেশ কি সেই বাংলাদেশ, যার জন্য রক্ত ঝরেছিল?
আজকের তরুণ প্রজন্ম, যাদের আমরা জেন জি বলি তারা ইতিহাস বইয়ের পাতায় যুদ্ধ দেখেছে, ইউটিউব ভিডিওতে ভাষণ শুনেছে, কিন্তু নিজের চোখে কোনো জাতীয় ঐক্যের বিস্ফোরণ দেখেনি। তারা জন্মেছে এক ক্লান্ত রাষ্ট্রে, যেখানে রাজনীতি বিশ্বাসযোগ্য নয়, রাষ্ট্রীয় ভাষা সন্দেহজনক, আর দেশপ্রেম প্রায়ই দলীয় শ্লোগানে বন্দি। এই প্রজন্মের ভেতরে তাই এক ধরনের দ্বিধা-একদিকে দেশ নিয়ে গভীর ভালোবাসা, অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রতি গভীর অবিশ্বাস।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তন সেই দ্বিধাকে আরও তীব্র করেছে। একটি দীর্ঘদিনের শাসক দলের পতন কেবল ক্ষমতার বদল নয়, এটি এক শূন্যতার জন্ম দিয়েছে। সেই শূন্যতায় ঢুকে পড়েছে মৌলবাদী ভাষ্য, পাকিস্তানপন্থার নতুন মোড়ক, ধর্মকে রাজনীতির একমাত্র বৈধ অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার দুঃসাহস। ইতিহাস যেন উল্টো হাঁটছে। যে দেশ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য রক্ত দিয়েছে, সেখানে আজ শিল্প ভয় পায়, কবিতা চুপ করে যায়, গান আত্মপক্ষ সমর্থনে নামে।
এই বাস্তবতায় তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা অমূলক নয়। তারা দেখে যুক্তি হার মানছে বিশ্বাসের কাছে, প্রশ্নকে দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে অপমান নামের ফতোয়ায় আর বন্ধুত্বকে সন্দেহ করা হচ্ছে মতাদর্শের ভিত্তিতে। ধর্ম এখানে আর আত্মার আশ্রয় নয়; এটি হয়ে উঠছে শাসনের হাতিয়ার। শিল্প যেন প্রতিদিন একটু একটু করে হেরে যাচ্ছে মাইকের আওয়াজে, উগ্রতার চিৎকারে।
তবু বাংলাদেশকে একমাত্র শঙ্কার আয়নায় দেখলে ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হবে। এই দেশ বারবার ভেঙে পড়ে, আবার উঠে দাঁড়ায়। এই মধ্যবিত্ত সমাজ যারা একাত্তরে গান লিখেছিল, নাটক করেছিল, দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার এঁকেছিল তারা কখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি। তারা চুপ করে ছিল, কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়নি। আজও সেই সাংস্কৃতিক পুনরুত্থানের বীজ ছড়িয়ে আছে ক্যাম্পাসের করিডোরে, ছোট নাট্যদলের রিহার্সাল রুমে, কবিতার ওপেন মাইকে, বিকেলের আড্ডায়।
ডিসেম্বর আমাদের সেই বীজের কথা মনে করায়। মনে করায়, সাহসী হওয়া মানে কেবল রাস্তায় নামা নয়। সাহস মানে গান গাওয়া, যখন গান নিষিদ্ধ হতে বসে। সাহস মানে কবিতা লেখা, যখন শব্দ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সাহস মানে বন্ধুত্ব, যেখানে মতভেদ থাকলেও মানবতা অটুট থাকে। আমি এমন তরুণ চাই, যারা লাল-সবুজের পতাকা হাতে শুধু শ্লোগান দেবে না বরং সেই পতাকার ইতিহাস জানবে, বহন করবে।
এই দেশের বিপ্লব কখনো কেবল বন্দুক দিয়ে হয়নি। এখানে বিপ্লব এসেছে রবীন্দ্রসংগীতের সুরে, গণনাট্যের সংলাপে, শহীদ মিনারের নীরবতায়। ধর্মীয় উগ্রবাদের পরাজয়ও আসবে সেখান থেকেই- সম্মিলিত জনজোয়ারে, যেখানে শিল্প, সাহিত্য ও মানবিকতা একসঙ্গে দাঁড়াবে। আবহমান বাংলার সম্প্রীতি কোনো কল্পকথা নয়; এটি এই মাটির স্মৃতি।
১৬ ডিসেম্বর তাই আমার কাছে আহ্বান—ঘরে ঘরে ডিসেম্বরের চেতনায় জাগ্রত হওয়ার ডাক। তরুণদের উদ্দেশে বলি, তোমরা ভয় পেও না। ইতিহাস তোমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। যতদিন একজন তরুণ গিটার হাতে গান গায়, একজন ছাত্রী কবিতা লেখে, একজন বন্ধু অন্য বন্ধুর পাশে দাঁড়ায়, ততদিন এই দেশ বেঁচে থাকে।
ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই দেশ একদিন জেগেছিল। আবার জাগবে।