সর্বশেষ

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন

ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক

প্রকাশিত: ৩০ নভেম্বর ২০২৫, ১৪:৩৫
জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে বিশেষভাবে আলোচনায় আছে—ফেব্রুয়ারির ৮ বা ১৪ তারিখ। নির্বাচন কমিশনের ভেতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র, মাঠপর্যায়ের লজিস্টিক প্রস্তুতি ও রমজান শুরুর সময় মিলিয়ে এই দুই তারিখকেই সবচেয়ে সম্ভাব্য বলা হচ্ছে।
ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক

বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জল্পনা আরও ঘনীভূত হয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা–ঝুঁকির মধ্যেই নির্বাচন কমিশন (ইসি) ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, তফসিল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঘোষণা হতে পারে। মক ভোটিং পর্যবেক্ষণ করে কেন্দ্রসংখ্যা, কক্ষ, ব্যালটবক্স, মানবসম্পদ এসবই ‘রিয়েল টাইম অ্যাসেসমেন্ট’ করে ঠিক করা হবে।

 

সে সূত্র ধরে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে বিশেষভাবে আলোচনায় আছে—ফেব্রুয়ারির ৮ বা ১৪ তারিখ। নির্বাচন কমিশনের ভেতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র, মাঠপর্যায়ের লজিস্টিক প্রস্তুতি ও রমজান শুরুর সময় মিলিয়ে এই দুই তারিখকেই সবচেয়ে সম্ভাব্য বলা হচ্ছে।

 

 

২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার সম্ভাব্য সময় ১৮ ফেব্রুয়ারি। ফলে নির্বাচনের দিন খুব বেশি পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কমিশন আগেই জানিয়েছে যে, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট—উভয় ভোট একই দিনে আয়োজন করতে হবে। এ কারণে তফসিল ঘোষণার পর কমপক্ষে ৬০ দিনের প্রস্তুতি বিবেচনায় ফেব্রুয়ারির ৮ এবং ১৪ তারিখ সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তারিখ হিসেবে উঠছে। ইসির একাধিক কর্মকর্তা ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভোটার তালিকা, ব্যালটপেপার, ব্যালটবক্স, অমোচনীয় কালি ও অন্যান্য উপকরণ ৯৫ শতাংশ প্রস্তুত। একইসঙ্গে ২৯ নভেম্বর মক ভোটিংয়ের মাধ্যমে কেন্দ্র–ব্যবস্থাপনা ও ভোটারের গড় সময় নির্ধারণের পরিকল্পনাও এগোচ্ছে।

 

ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে, বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনী মাঠে থাকবে, এবং তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বহাল থাকবে। ২৯ নভেম্বর সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তি ও প্রতিনিধিদের নিয়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। 

 

এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি–রাজনৈতিক সমন্বয়ও চলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন এবং মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের রদবদল মিলিয়ে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

 

অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে কি?

 

আওয়ামী লীগ আমলে সরকারি ভাবে কোনও দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা হয়নি। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিলো নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়ে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক বাতিল হওয়ায় ২০১৮ সালে তারা বিএনপির সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

 

কিন্তু এবার অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করেছে এবং এর সূত্র ধরে নির্বাচন কমিশনও আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। কিন্তু জাতীয় পার্টি বা ১৪ দলের বিষয়ে এমন কোনও সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি। তাই এবারের নির্বাচনের অন্যতম আলোচিত প্রশ্ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত হবে? কারণ দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত, এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের নিবন্ধন স্থগিত করেছে। এতে একপক্ষীয় নির্বাচনের আশঙ্কা বাড়ছে। 

 

 

যদিও আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনকে সামনে রেখে দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। ছোট ছোট অনেক দলই এখন এই দুই বলয়ে বিভক্ত। তারপরেও ভোটের রাজনীতিতে এদের সবারই দীর্ঘকালীন পরিচিত হলো 'আওয়ামী লীগ বিরোধী' হিসেবেই।

 

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন ও পুরনো কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে 'নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া যাবে না', আবার কোনও দল বলছে 'বিচারের আগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল' কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না'। আর সেটি হলে সামনের নির্বাচনটিতে শুধুমাত্র 'আওয়ামী লীগ বিরোধীদেরই' দেখা যাবে বলে মনে করছেন অনেকে।

 

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে পিলখানায় নিহতদের স্মরণানুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেছিলেন, “আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি।” তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, সরকারের প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বরের মধ্যেই বা তার কাছাকাছি সময়ে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও তাঁর আলোচনার উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে উভয়েই একমত।

 

বাস্তবিক অবস্থা: রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও বিতর্ক

 

কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হবে কীভাবে? প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রীকে জানিয়েছেন, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় কার্যক্রম স্থগিত থাকায় এবং নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। 

 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের কোনো মামলায় কারও বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে সেই ব্যক্তি জাতীয় সংসদ এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এছাড়া সম্প্রতি মামলায় পলাতক আসামিরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না - এমন বিধান রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

 

 

আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ছাড়াও দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কয়েক হাজার মামলা হয়েছে গত ১৫ মাসে। শীর্ষ থেকে মাঝারি নেতাদের অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছেন, আবার অনেকে আত্মগোপনে রয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে।

 

এদিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো চিঠি দিয়ে বলছে, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।

 

রাজনৈতিক মহলে আবার কেউ কেউ বলছে, নিষেধাজ্ঞা হলে নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিএনপি বলছে, নির্বাহী আদেশে দল নিষিদ্ধ না করে বিচারিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ঢালাওভাবে দল নিষিদ্ধের দাবির মধ্যে রাজনৈতিক কৌশলও থাকতে পারে, বিশেষত বিএনপিকে শেষ মুহূর্তে জটিল অবস্থায় ফেলার জন্য।

 

আওয়ামী লীগ আমলে ২০২৪ সালের নির্বাচনেও ২৮টি নিবন্ধিত দল অংশ নিয়েছিলো। বিএনপি ও সমমনা সব দল ওই নির্বাচন বর্জন করেছিলো। এসব দল নির্বাচনের বাইরে থেকে গেলে এবং এখন যারা আওয়ামী লীগ ও তাদের সাথে নির্বাচনে থাকা জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিরোধিতা করছে শেষ মুহূর্তে তারাও 'নিজেদের সুবিধা মতো দাবি আদায়ের জন্য' নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কী হবে- সেই উদ্বেগ আছে বিএনপির ভেতরেও।

 

সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার আশা প্রকাশ করেছেন, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বড় অংশ ভোটার হিসেবে ভোট দিতে আসবেন, যদিও তারা প্রার্থী হতে পারবেন না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দল নিষিদ্ধ অবস্থায় তাদের সমর্থকরা ভোটে অংশ নেবেন তা আশা করা নিতান্তই বালখিল্যতা।

 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন দলনির্ভর নয়, বরং বর্জন, নিষেধাজ্ঞা ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে গভীরভাবে বিভক্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর নানা অবস্থান, আইনি গিঁট, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি মিলে নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, অনিশ্চয়তা ততই বাড়ছে।

 

শেষ প্রশ্নটি তাই আবারও ফিরে আসে— ফেব্রুয়ারির ৮ বা ১৪ তারিখে কি সত্যিই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুদলীয়, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব?

 

ডিসেম্বরের প্রথম–দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রশ্নের উত্তর আরও স্পষ্ট হবে।

সব খবর

আরও পড়ুন

যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

মতামত ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

রঙতুলির বিদ্রোহ শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

মানবাধিকার সংকটের নতুন আতঙ্ক নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

ব্যঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

ব্যঙ্গ কলাম ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?

মতামত তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?