সর্বশেষ

মানবাধিকার সংকটের নতুন আতঙ্ক

নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:৩০
নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা বহুবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, এবং নাগরিকের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে টেলিভিশন নাট্য পরিচালক, সংস্কৃতিকর্মী এবং ডিরেক্টরস গিল্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগরের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা আবারও সেই প্রশ্নকে সামনে এনেছে। পাঁচ দিন ধরে তার কোনো খোঁজ না পাওয়ায় পরিবার, সহকর্মী, সংস্কৃতি অঙ্গন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

 

টেলিভিশন নাট্য পরিচালক, সংস্কৃতিকর্মী এবং ডিরেক্টরস গিল্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এম কামরুজ্জামান সাগর গত ৫ দিন ধরে নিখোঁজ রয়েছেন বলে তার পরিবার ও সহকর্মীরা জানিয়েছেন। তাকে শেষবার দেখা গিয়েছিল নিজ বাড়ির সামনে বুধবার রাত ১০ টায় , এর পর থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এবং তিনি আর বাড়ি ফেরেননি।

 

পরিবারের সদস্যরা জানান, সাগরের হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক এবং তারা তার নিরাপত্তা নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন। তার ঘনিষ্ঠজনদের দাবি, তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয় ভূমিকা এবং ভারতীয় টিভি চ্যানেল রিপাবলিক বাংলার সাথে একটি সাক্ষাৎকারের কারণে চাপ ও হুমকির মুখে ছিলেন , তিনি জুলাই আন্দোলনে সেলিব্রেটিদের মাঝে ব্যয় করা আমেরিকান ডলারের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানতেন। জনতার সামনে ঐ সমস্ত তথ্য যেনো না আসে এজন্য তাকে দেড় বছর যাবৎ হুমকি দিয়ে আসছিলো ইউনূস-বিএনপি ও জামাতের দোসরেরা।তবে তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ সম্পর্কে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি।

 

সাগর শুধু একজন পরিচালক নন—তিনি মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং রাষ্ট্রের মূল্যবোধের পক্ষে সোচ্চার একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সামাজিক মাধ্যম থেকে সাংস্কৃতিক মঞ্চ—সব জায়গায় তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রগঠন দর্শনের পক্ষে কথা বলেছেন। তার লেখালেখি ও উপস্থাপনায় নতুন প্রজন্ম বারবার উদ্বুদ্ধ হয়েছে।

 

এই প্রকাশ্য অবস্থান অনেকের মতে তাকে রাজনৈতিক বিদ্বেষ, হুমকি ও নজরদারির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তোলে। সহকর্মীদের দাবি—সাগর ‘জুলাই আন্দোলন’ চলাকালে সেলিব্রেটিদের মাঝে অর্থ বিতরণ নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতেন, এবং এ নিয়ে তাকে দীর্ঘদিন ধরে চাপ ও হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
 

সাগরের নিখোঁজ হওয়া যেমন রহস্যময়, তেমনি উদ্বেগজনক। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী পাঁচ দিন ধরে তার কোনো যোগাযোগ নেই, মোবাইল বন্ধ, কেউ জানে না তিনি কোথায়, এবং অভিযোগ উঠছে যে তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভূমিকা থাকতে পারে।


তবে ঘটনাটির বিষয়ে এখনো সরকারি কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না আসায় পরিস্থিতি আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নাগরিক সমাজ মনে করছে—একজন সুপরিচিত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিখোঁজ হওয়া শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চরিত্রের ওপর আঘাত।

 

টেলিভিশন পরিচালক, অভিনেতা, গিল্ডের সদস্য এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মীরা এই ঘটনাকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের ওপর সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখছেন। কারণ—সাগরদের মতো মানুষ হলেন সেই সৃজনশীল শক্তি যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেন এবং সমাজে মানবিকতা ছড়িয়ে দেন। তাদের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পুরো সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

 

এস এম কামরুজ্জামান সাগরের নিখোঁজ হওয়া শুধু একজন ব্যক্তির অনুপস্থিতি নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সামনে এক ভয়ংকর প্রশ্নচিহ্ন। একজন সাংস্কৃতিক যোদ্ধার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক, মানবিক ও সাংবিধানিক দায়িত্ব।

 

আমরা আশা করি, খুব দ্রুত তার সন্ধান মিলবে এবং সত্য প্রকাশ পাবে। সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ এই উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাবে—এটাই প্রত্যাশা।

 

গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো—নাগরিকের নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আইনের নিশ্চয়তা। কোনো রাষ্ট্রে যদি মানুষ হঠাৎ করে নিখোঁজ হতে থাকে, কোনো মামলার নথি না থাকে, কোনো সরকারি ব্যাখ্যা না আসে, আর পরিবারগুলো বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় থাকে—তাহলে সেটি শুধু আইনশৃঙ্খলা সমস্যাই নয়; এটি এক গভীর মানবাধিকার সংকট, যা সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গুম, খুন ও নিখোঁজের অভিযোগ উদ্বেগজনকভাবে সামনে এসেছে। বিভিন্ন পরিবার, মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সমাজ ক্রমাগত অভিযোগ জানাচ্ছে যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মতাদর্শিক বিরোধ কিংবা ক্ষমতার টানাপোড়েনের কারণে মানুষ হঠাৎ উধাও হয়ে যাচ্ছে। যদিও সরকারি তথ্য প্রায়ই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে, তবুও বাস্তবতা হলো অসংখ্য পরিবার এখনও প্রিয়জনের খোঁজে পথে পথে ঘুরছে।

 

গুম শুধু একজন মানুষের অনুপস্থিতি নয় এটি পুরো একটি পরিবারের মানসিক মৃত্যু। একজন বাবা নিখোঁজ হলে একটি পরিবার দিশেহারা হয়, একটি শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যায়, একটি মা প্রতিদিন দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে হয়তো ফিরে আসবে বলে।

 

গুমের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো অনিশ্চয়তা। মৃত হলে লাশ পাওয়া যাবে, কবর হবে। গত ১৪ মাসে  ইউনুস সরকারের শাসনে ৫ হাজার নিখোজ সুধু আওয়ামীলীগ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নেওয়া পরিবারের সদস্য।

 

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয়, মতপ্রকাশে সাহসী, অথবা কোনো ঘটনার সাক্ষী। এ কারণে রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় শক্তির দ্বারা টার্গেট হওয়ার অভিযোগ ওঠে।
 

এ ধরনের অভিযোগ সরকার যাই বলুক, সমাজে প্রশ্ন তৈরি হয় নিরাপত্তা কি ক্ষমতাশালী লোকদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ছে?

 

গুম-খুনের মতো ঘটনা যখন বাড়তে থাকে, তখন সমাজে একটি ভুল ধারণা তৈরি হয়, “এটা রাজনীতির ব্যাপার, আমাদের বলার কিছু নেই।” এই ভয়ই ভয়ংকর।
 

কারণ গুম কখনোই শুধু রাজনীতিবিদের ঘটনা নয়; আজ যাকে নেওয়া হচ্ছে, কাল সে হতে পারে সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, শিক্ষক যে কেউ। নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি যখন গড়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকই নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে।

সব খবর

আরও পড়ুন

যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

মতামত ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

রঙতুলির বিদ্রোহ শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

ব্যঙ্গ মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

ব্যঙ্গ কলাম ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?

মতামত তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?

ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক