সকল প্রশংসা সেই মহান পাকিস্তানের, যাঁহার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সদ্যই ইসলামের খাতিরে বাংলাদেশকে অতীত ভুলিয়া যাওয়ার মহৎ পরামর্শ প্রদান করিয়াছেন। আহা! কী মহৎ হৃদয়! কী পবিত্র অভিপ্রায়! যেন একখণ্ড আরশে মোকামের রঙিন রুমাল উড়িয়া আসিল বঙ্গোপসাগরের বাতাসে।
বাংলাদেশের জন্ম লগ্নে পাকিস্তান যখন ত্রিশ লক্ষ মানুষকে ইসলামের দোহাই দিয়ে সাফ করিয়া দিল, তখন পাকিস্তানের আকাশে ধর্মের পতাকা এমনভাবে পতপত করিতে লাগিল, যেন ফেরেশতাগণও বিভ্রান্ত হইয়া পড়িলেন—এ কি ধর্মের জ্যোতি, না রক্তের ছিটেফোঁটা? যখন দুই লক্ষ বাংলার নারী ধর্ষিত হইলেন পাকিস্তানিদের ধর্মরক্ষার মহান ব্রত পালনে, তখন ধর্ম এমন জৌলুশে চমকাইতে লাগিল, যে চমক আরশে মোকাম পর্যন্ত পৌঁছাইয়া গেল। ফেরেশতাগণ হয়তো ভাবিলেন, “ইহাই বুঝি নবধর্মীয় জিহাদ!”
পাকিস্তান তখন ইসলামের নাম লইয়া এমন এক খেলায় মত্ত, যাহা দেখিয়া শয়তানও লজ্জায় মুখ ঢাকিল। এক মুসলিম রাষ্ট্র আরেক মুসলিম রাষ্ট্রের উপর এমন নিপীড়ন চালাইল, যেন ইসলাম হইল তাদের কাছে অত্যাচারের লাইসেন্স। ধর্মের দোহাই দিয়া শোষণ, নিপীড়ন, ধর্ষণ, হত্যা—সবই হইল ‘পবিত্র’ কর্ম। আহা! কী সৌন্দর্য! কী ধর্মীয় নৈতিকতা!
ইসলাম কি এতই ঠুনকো, যে তাহা অত্যাচারীর হাতিয়ার হইয়া মজলুমের রক্তে সিক্ত হইবে? না কি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের সংজ্ঞায় ইসলাম মানে ‘যাহা খুশি তাহাই করো, শুধু দোহাই দাও’? বাংলার মুসলমানেরা কি এতই বোকা, যে বারবার এই ধর্মীয় তামাশায় অংশগ্রহণ করিবে? না কি আমাদের সরকার এতই বেহায়া, যে এই ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদ করিবে না?
পাকিস্তান আজ বাংলাদেশের বুকে দাঁড়াইয়া বলিতেছে—“ভুলে যাও অতীত, ইসলামের খাতিরে।” বাহ! যেন ধর্ষকের মুখে নৈতিকতার ভাষণ। যেন খুনির হাতে শান্তির পতাকা। যেন আগুনের মধ্যে শান্তির ফুল ফোটানোর চেষ্টা।
বাংলাদেশের জন্ম লগ্নের ক্ষত, শহীদের রক্ত, মা-বোনের আর্তনাদ—সবই কি ইসলামের খাতিরে ভুলিয়া যাওয়া যাইবে? যদি তাই হয়, তবে ধর্ম কি শুধুই এক রাজনৈতিক মুখোশ? এক কলঙ্কিত ব্যানার, যাহা দুনিয়ার দরবারে ধর্মকে তামাশা বানায়?
পাকিস্তানের এই ঔদ্ধত্য, আর আমাদের সরকারের নির্লজ্জ নীরবতা—দুইই যেন এক ব্যঙ্গচিত্র। একদিকে ধর্মের নামে ধোঁকা, অন্যদিকে আত্মমর্যাদার নামে আত্মবিক্রয়। এই ব্যঙ্গের মঞ্চে আমরা সবাই দর্শক, কেউ কেউ অভিনেতা, আর ইসলাম? সে হয়তো এক কোণে বসিয়া কাঁদিতেছে—“আমি তো এমন ছিলাম না…”
লেখকঃ এক ক্লান্ত পেনসিল; যে তাহার কলঙ্কিত সময়ের দিনলিপি লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে