সর্বশেষ

বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য প্রভাব

রাজনৈতিক কথামালা ছলনা, পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন বাস্তবতার গল্প

প্রকাশিত: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৪:২৬
রাজনৈতিক কথামালা ছলনা, পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন বাস্তবতার গল্প
ছবিঃ বণিক বার্তা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধী স্লোগান নতুন কিছু নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার ও তাদের অংশীজনদের রাজনৈতিক বক্তব্যে ভারত-বিরোধিতা যেন বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। রাজনৈতিক বক্তৃতায় ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের জন্য। সীমান্ত হত্যা থেকে শুরু করে বাণিজ্য বৈষম্য—সব কিছুর বিরুদ্ধেই জনসমক্ষে তীব্র সমালোচনা করা হচ্ছে।

 

তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান প্রমাণ করছে, রাজনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও কূটনৈতিক দূরত্ব সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা ভারতের ওপর কমেনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। খাদ্যশস্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি—সব ক্ষেত্রে ভারত এখনো ঢাকার অন্যতম প্রধান উৎস।

 

রাজনৈতিক টানাপোড়েন, অর্থনীতির ভিন্ন ধারা

 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বড় ধরনের অস্থিরতা নেমে আসে। ভারত বাংলাদেশীদের ভিসা দেওয়া সীমিত করে, বেশ কিছু পণ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, পোষাক রপ্তানির জন্য বন্দর সুবিধা বাতিল করে, জবাবে বাংলাদেশকে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা না গেলেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিতর্কিত মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেননি সরকার ঘনিষ্ঠরা।

 

কিন্তু বাণিজ্যের হাল-হকিকত দেখাছে ভিন্ন চিত্র। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) ভারত থেকে বাংলাদেশে রফতানি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ১৪৯ কোটি ডলারের পণ্য। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এতে স্পষ্ট, রাজনৈতিক উত্তেজনা অর্থনীতির প্রবাহকে আটকাতে পারেনি অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের সকল তর্জন গর্জনই সার!

 

খাদ্য আমদানিতে ভারতের অপরিহার্যতা

 

বাংলাদেশে চাল বা পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হলেই ভারতের দিকে ঝুঁকতে হয় সরকারকে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। ফলে দাম দ্রুত কিছুটা কমে আসে।

 

ভারতের বাণিজ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাত্র ১৬ কোটি ডলারের চাল আমদানি করেছিল। কিন্তু ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬১ কোটি ডলারে। প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় আশ্চর্যজনকভাবে ২ হাজার ১৭৪ শতাংশে। একই সময়ে পেঁয়াজ-রসুন আমদানি বেড়েছে ১.৭৮ শতাংশ।

 

এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য ভারত এখনো অপরিহার্য উৎস।

 

পোশাক শিল্পের কাঁচামালে ভারতীয় প্রভাব

 

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। কিন্তু এই খাতের প্রধান কাঁচামাল তুলা ও সুতা ব্যাপকভাবে আসে ভারত থেকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত থেকে তুলা আমদানি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০৩ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি।

 

সুতা আমদানিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলেও তা সমুদ্রপথে অব্যাহত থেকেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধ হওয়ার পরও গড়ে প্রতি মাসে ৪–৫ কোটি কেজি সুতা এসেছে ভারত থেকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিলেও অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমানো সম্ভব হয়নি।

 

জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভারতের ভূমিকা

 

বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ৭৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে ভারত থেকে, যা জাতীয় চাহিদার ১৫ শতাংশেরও বেশি। অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি ঘাটতি থাকায় ভারতীয় সরবরাহ ছাড়া চাহিদা পূরণ সম্ভব হচ্ছে না।

 

শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ ক্রয়ে ভারতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের চুক্তি নিয়ে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালালেও, দেখা গেল অন্তর্বর্তী সরকার পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় দ্রুত আদানির দেনা পরিশোধ করছে। এতে ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব আরও জোরালো হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য

 

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, “রাজনৈতিক টানাপোড়েন সাময়িক হলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক মূলত বাস্তব চাহিদা ও বাজারের সক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের গ্রহণযোগ্যতা এই বাণিজ্যকে ধরে রেখেছে।”

 

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের মতে, “বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে তিনদিক থেকে ভারতের ঘেরা। এ অবস্থায় বিকল্প উৎস খোঁজা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নির্ভরতা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। বরং বাস্তবসম্মত কৌশল হতে পারে একাধিক উৎস তৈরি করা, যাতে খরচ ও সময় উভয়ই বিবেচনায় রাখা যায়।”

 

অন্তর্বর্তী সরকার ও বিভিন্ন অংশীজন প্রকাশ্যে “ভারত-বিদ্বেষী” রাজনৈতিক বক্তব্য ও জনতুষ্টিমূলক কৌশল গ্রহণ করলেও বাস্তবে ভারতের ওপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা আরও সুস্পষ্টভাবে বজায় রয়েছে। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ পর্যন্ত—প্রতিটি খাতে ভারতের ভূ-অর্থনৈতিক প্রভাব আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়েছে বরং। পরিসংখ্যানের ভাষায়, ঢাকার অর্থনীতি এখনো গভীরভাবে দিল্লির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

সব খবর

আরও পড়ুন

নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতার ওপর ডিম নিক্ষেপ, কনস্যুলেট কর্মীদের বিরুদ্ধে এনসিপির অভিযোগ

নিউ ইয়র্কে এনসিপি নেতার ওপর ডিম নিক্ষেপ, কনস্যুলেট কর্মীদের বিরুদ্ধে এনসিপির অভিযোগ

৫ রাজনীতিক নিয়ে নিউইয়র্কের পথে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস

৫ রাজনীতিক নিয়ে নিউইয়র্কের পথে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস

বাগেরহাটে আসন পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন, ফরিদপুরে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত

বাগেরহাটে আসন পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন, ফরিদপুরে অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত

নির্বাহী আদেশে দল নিষিদ্ধ ভয়ংকর চর্চা: সালাহউদ্দিন আহমেদ

নির্বাহী আদেশে দল নিষিদ্ধ ভয়ংকর চর্চা: সালাহউদ্দিন আহমেদ

রিজভীর দাবি, নির্দিষ্ট সংগঠনকে জয়ী করতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ

ডাকসু-জাকসু নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ রিজভীর দাবি, নির্দিষ্ট সংগঠনকে জয়ী করতে চেয়েছে কর্তৃপক্ষ

লুৎফুজ্জামান বাবরকে ‘স্যার স্যার’ করে জড়িয়ে ধরলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর

লুৎফুজ্জামান বাবরকে ‘স্যার স্যার’ করে জড়িয়ে ধরলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর

মৌলবাদীরা ‘বেহেশতের টিকেট’ বিক্রি করছেঃ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

মৌলবাদীরা ‘বেহেশতের টিকেট’ বিক্রি করছেঃ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

৩৬ ঘণ্টা পরও ফলাফল অনিশ্চিত, উত্তেজনা ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ

জাকসু নির্বাচন ৩৬ ঘণ্টা পরও ফলাফল অনিশ্চিত, উত্তেজনা ও অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ