সর্বশেষ

অতিরিক্ত ব্যয় ও সুরক্ষার ঘাটতি

সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেও কম আয় বাংলাদেশি কর্মীদের

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১:৩১
সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করেও কম আয় বাংলাদেশি কর্মীদের

আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর), আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—‘দক্ষতা নিয়ে যাবো বিদেশ, রেমিট্যান্স দিয়ে গড়বো স্বদেশ।’ অতিরিক্ত ব্যয় ও সুরক্ষা ঘাটতির মধ্যে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস।

 

বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের বিদেশে যেতে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়, অথচ আয় তুলনামূলকভাবে কম। সরকারের নির্ধারিত অভিবাসন খরচের তুলনায় বাস্তবে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিতে হয়। এর বড় অংশ চলে যায় দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী ও শ্রমবাজার সিন্ডিকেটের পকেটে। ফলে কর্মীরা ঋণগ্রস্ত হয়ে বিদেশে যান এবং দীর্ঘ সময় ধরে সেই টাকা তুলতে হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার জরিপে দেখা যায়, একজন বাংলাদেশিকে বিদেশ যেতে গড়ে ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। অথচ মাসিক গড় আয় মাত্র ২৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ খরচের টাকা তুলতে সময় লাগে প্রায় ১৭ মাস। দক্ষ পুরুষ কর্মীদের ক্ষেত্রে ব্যয় আরও বেশি—৪ লাখ ২৭ হাজার টাকা। অদক্ষ কর্মীদের ক্ষেত্রে তা দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। গৃহকর্মীদের খরচ তুলনামূলক কম হলেও আয়ও কম।

 

সরকার ২০১৬ সালে বিভিন্ন দেশের জন্য অভিবাসন খরচ নির্ধারণ করেছিল। যেমন—সিঙ্গাপুরে ২ লাখ ৬২ হাজার টাকা, সৌদি আরবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে সিঙ্গাপুরে যেতে খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকা, সৌদি আরবে ৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। মালয়েশিয়া, কাতার ও ওমানেও খরচ নির্ধারিত ফি’র তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।  

 

বিদেশফেরত কর্মীরা জানান, সৌদি আরবে যেতে একজন শ্রমিককে ৫ থেকে ৯ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। মালয়েশিয়ায় খরচ হয় ৩.৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। এসব খরচের মধ্যে থাকে ভিসা ফি, ওয়ার্ক পারমিট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রশিক্ষণ, বিমান ভাড়া, কর, ইনস্যুরেন্স, এজেন্সি চার্জসহ নানা খরচ। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গোপন খরচ (হিডেন কস্ট), যা মূলত দালাল ও অবৈধ এজেন্টদের পকেটে যায়।  

 

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে ভিসা বাণিজ্য এখনও চলছে। ভিসা কিনে এনে কর্মীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হয়। এতে অভিবাসন ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’-তে খরচ সবচেয়ে বেশি। যেমন—কুয়েতে নিয়মিত ভিসায় খরচ ৬ লাখ টাকার মতো হলেও ‘ফ্রি ভিসায়’ খরচ হয় প্রায় ৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।  

 

অতিরিক্ত খরচের কারণে অনেক কর্মী ঋণ নিয়ে বিদেশ যান। ফলে তারা যেকোনো মূল্যে আয় করতে চান এবং দ্রুত দেশে টাকা পাঠাতে চান। এজন্য অনেকেই বৈধ চ্যানেলের বদলে হুন্ডি ব্যবহার করেন, যেখানে বিনিময় হার বেশি এবং প্রক্রিয়া সহজ। এতে জাতীয় রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  

 

বিশেষজ্ঞদের মত  
 

ওকাপ চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘অভিবাসন ব্যয়ের পেছনে বাংলাদেশি কর্মীদের সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। গবেষণায় এক হাজার ৮৪ জন অভিবাসীর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে ৫১ শতাংশ কর্মী তথাকথিত ফ্রি ভিসা এবং ৪৯ শতাংশ কর্মী কাজের ভিসা নিয়ে বিদেশ গেছেন। ফ্রি ভিসা শব্দটি বিভ্রান্তিকর। এটি বিনামূল্যে বা আইনগতভাবে স্বীকৃত নয়। এর পরিবর্তে এটি শোষণমূলক নেটওয়ার্কের জন্য একটি সরঞ্জাম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অভিবাসন ব্যয় বাড়িয়ে তুলেছে, পরিবারগুলোকে ঋণের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে এবং জাতীয় রেমিট্যান্স প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে।

 

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. জালাল উদ্দিন সিকদারের মতে, রেমিট্যান্স পাঠাতে হুন্ডির প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অভিবাসন ব্যয় অনেকাংশে দায়ী। তিনি বলেন, ‘‘নির্ধারিত ব্যয়ের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে হচ্ছে। এই টাকা চড়া সুদে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। আবার অনেকে সম্পদ বিক্রি করে পাড়ি জমান বিদেশে। তাই যেকোনও মূল্যে উপার্জনের একটা চাহিদা তৈরি হয়। যেদিন থেকে কাজ শুরু করেন, সেদিন থেকেই দেশে টাকা পাঠানোর পরিকল্পনা করেন কর্মীরা। আর হুন্ডিতে বিনিময় মুদ্রা বেশি হওয়ার কারণে তারা সেই মাধ্যমেই টাকা পাঠাতে আগ্রহী হন। আবার হুন্ডি ব্যবসায়ীরা কর্মীদের সেবা দেন হাতে হাতে। অর্থাৎ একজন কর্মীকে হুন্ডিতে দেশে টাকা পাঠাতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু বৈধ চ্যানেলে পাঠাতে তাকে অনেক দূর থেকে সফর করে অন্য জায়গায় যেতে হয়।’’

 

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান মনে করেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ না করলে অভিবাসন খরচ কমানো সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ, সেটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সরকার প্রত্যেকটা দেশের জন্য নির্ধারিত খরচ বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু কাগজে-কলমেই সেটা আছে। যারা বিদেশে লোক পাঠায় তারা অনেক সময়েই অনেকগুণ বেশি টাকা নেন। এর কারণ, বিদেশে যেমন মধ্যস্বত্বভোগী আছে, দেশেও তেমনই নানা স্তরে দালালদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। ফলে আট থেকে ১০ লাখ টাকাও লাগে বিদেশে যেতে। এছাড়া পদে পদে আছে ভোগান্তি-হয়রানি। পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র—সব ক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা।’’

 

তিনি বলেন, ‘‘দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কী।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমাদের বিদেশ যাওয়ার প্রসেসটা এখনও দালালনির্ভর। যার কারণে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি এবং আয় সবচেয়ে কম। অভিবাসন খরচ কমানোর একটা বড় উপায় হলো—অভিবাসন প্রক্রিয়া ঠিক করা এবং দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা।’’

 

অভিবাসন ব্যয় কমানো গেলে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। এজন্য প্রয়োজন—  
 

- অভিবাসন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা  
- দালাল ও ভিসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ  
- দক্ষ শ্রমিক তৈরি  
- বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহ দেওয়া

সব খবর

আরও পড়ুন

কুমিল্লায় থানা হেফাজতে নারী আসামির মৃত্যু

কুমিল্লায় থানা হেফাজতে নারী আসামির মৃত্যু

অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর ‘মহোৎসব’ বাংলাদেশে

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২৫ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর ‘মহোৎসব’ বাংলাদেশে

সেনা কর্তৃত্বের কারণেই আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে না: ইফতেখারুজ্জামান

সেনা কর্তৃত্বের কারণেই আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত হচ্ছে না: ইফতেখারুজ্জামান

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান

চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংলাপ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান

কড়াইলে অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পরও খোলা আকাশের নিচে ১০ হাজার মানুষ

পানি–স্যানিটেশন–পুনর্বাসনে নেই সরকারি উদ্যোগ কড়াইলে অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পরও খোলা আকাশের নিচে ১০ হাজার মানুষ

আন্তর্জাতিক সহায়তা অর্ধেকে নেমে এসেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে সাড়া নেই

গভীর মানবিক সংকটে রোহিঙ্গারা আন্তর্জাতিক সহায়তা অর্ধেকে নেমে এসেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ডাকে সাড়া নেই

চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার ‘ছাত্রলীগ কর্মীকে’ থানা হেফাজতে নির্যাতন

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার ‘ছাত্রলীগ কর্মীকে’ থানা হেফাজতে নির্যাতন

১১ মাসে নিহত ৩১ জন, জবাবদিহিতার ভয়াবহ সংকট

হেফাজতে মৃত্যুর বিস্তার ১১ মাসে নিহত ৩১ জন, জবাবদিহিতার ভয়াবহ সংকট