দেশে ‘মব’ বা গণ সহিংসতা থামানো যাচ্ছে না, সরকারের কঠোর বার্তা ও সেনাপ্রধানের হুঁশিয়ার সত্ত্বেও। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৩ মাসে অন্তত ২২০ জন নিহত হয়েছেন। শুধুমাত্র চলতি বছরের মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত ছয় মাসে ২৩0টি মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৭৯ জন নিহত এবং ২৬৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
সর্বশেষ ঘটনা ঘটে গতকাল বৃহস্পতিবার কুমিল্লার হোমনায়। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হাত মাইকে ঘোষণা দিয়ে একদল ব্যক্তি কফিল উদ্দিন শাহর মাজার ও দরগায় হামলা চালায়, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে।
এর আগে ৫ সেপ্টেম্বর রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরা পাগলার দরবার শরিফে হামলায় রাসেল মোল্লা (২৮) নিহত হন। এছাড়া লাশ কবর থেকে তুলে রাস্তায় পুড়িয়ে দেয় একদল জনতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং মৃদু পদক্ষেপের কারণে এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “মৃতদেহ কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা এক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং সহিংস জনমতের উদ্বেগজনক প্রকাশ। যদি রাষ্ট্র কঠোর অবস্থান না নেয়, তাহলে জনগণের আস্থা আরও দুর্বল হয়ে যাবে।”
টাঙ্গাইলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর, নাটোর ও পটুয়াখালীর চোর বা ডাকাত সন্দেহে গণপিটুনি এবং শিক্ষকদের ওপর হামলার মতো ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিতভাবে ঘটছে। মব সহিংসতার শিকার হচ্ছেন পুলিশ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ এবং বিদেশিরাও। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলাকারীরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’ হিসেবে।
ভয়েস ফর রিফর্ম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ৫৬ শতাংশ, রাতে চলাচলের নিরাপত্তা নিয়ে ৬১ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্ন। মানুষের মধ্যে ভয় ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা এবং ঢিলেঢালা মনোভাবের কারণে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, মব সহিংসতা সামাজিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক। এ ধরনের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী। সরকারের দায়িত্ব এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
পাশাপাশি আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে ১২৮ জন নিহত, ২০২৩ সালে ৫১, ২০২২ সালে ৩৬, ২০২১ সালে ২৮ এবং ২০২০ সালে ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং জনমনে ভয় কমাতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। পুলিশের কার্যক্রমকে আরও সক্রিয় করতে হবে এবং সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে।
সার্বিকভাবে, মব সহিংসতা দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কঠোর নীতি এবং সচেতন নাগরিক সমাজই একমাত্র সমাধান হতে পারে।