বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সুরক্ষা ব্যাহত হওয়ার জন্য দীর্ঘদিনের সেনা কর্তৃত্ব ও কাঠামোগত বৈষম্যকে দায়ী করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ৭ ডিসেম্বর রাজধানীতে মানবাধিকার সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের আয়োজিত জাতীয় কর্মশালায় তিনি বলেন, “যে বাহিনী বিশ্বজুড়ে শান্তিরক্ষা মিশনে সুনাম অর্জন করছে, সে বাহিনী কেন দেশের ভেতর শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ—এই প্রশ্ন অবশ্যম্ভাবী।”
তিনি আরও বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের পর আশা ছিল আদিবাসী জনগণ অধিকতর অন্তর্ভুক্তি ও মর্যাদা পাবে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বরং অধিকার-সংকট আরও তীব্র হয়েছে। তার মতে, সেনা কর্তৃত্বের সমাধান না হলে সরকার চাইলে জাতিসংঘের কাছে পরিস্থিতি হস্তান্তর করতে পারে।
কর্মশালায় ফ্রান্স দূতাবাসের পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের কর্মকর্তা এমিলি উল্লেখ করেন, কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী আদিবাসী জনগোষ্ঠী ভূমি, সংস্কৃতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ-অধিকারে হুমকির মুখে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বৈষম্য আদিবাসী নারীদের আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তিনি বলেন, এসব সমস্যা সমাধানে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা অত্যন্ত জরুরি এবং এই ক্ষেত্রে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে ফ্রান্স।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট পার্থ শঙ্কর সাহা অভিযোগ করেন, দেশে হত্যা-ধর্ষণের মতো অপরাধ এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হলেও কার্যকর আইন প্রয়োগ নেই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এখনো পূর্ণভাবে গঠিত হয়নি, যা অধিকার সুরক্ষাকে আরও দুর্বল করেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি জনা গোস্বামী বলেন, সমতলের বহু আদিবাসী আজও সুসংগঠিত নয়; ভূমি দখল, নিপীড়ন ও বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় প্রশাসন প্রায়ই নির্লিপ্ত থাকে। ডিজিটাল নিরাপত্তা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কথা বলতে সাহস পান না; মব জাস্টিসের ভয়ও বড় বাধা।
এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, গণতান্ত্রিক সরকার ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া আদিবাসী অধিকার রক্ষা সম্ভব নয়। তিনি সাংবিধানিক স্বীকৃতি, বিশেষ আসন, পৃথক জনশুমারি এবং ভূমি কমিশন গঠনের দাবি জানান।
সভাপতির বক্তব্যে কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন গোরাঙ্গ পাত্র বলেন, “২৪-এর বহুত্ববাদের স্বপ্ন এখন মৌলবাদীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত।” পাহাড়ে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এবং আদিবাসীদের পেশা, নারীর নিরাপত্তা ও অনলাইন হয়রানির বিষয়গুলোকেও তিনি উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্রজেক্ট অফিসার ত্রিজিনাদ চাকমা জানান, ২০২৪ সালে দেশে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মোট ৯৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে; যার মধ্যে ভূমি-সংক্রান্ত ১৮টি। ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে ৪৯টি ঘটনায় ৩৬৮ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার হয়নি।
তিনি পাঁচ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেন—পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন, সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সমতলে পৃথক ভূমি কমিশন, বিচারহীনতা বন্ধ, এবং আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
কর্মশালায় মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।