২০২৪ সালের ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে আদিবাসী জুম্ম জনগণের উপর সংঘটিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলা, হত্যাকাণ্ড, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের এক বছর পূর্ণ হলেও আজও বিচার হয়নি। হামলাকারীদের অধিকাংশ এখনো শাস্তির বাইরে থেকে গেছে, আর তদন্ত প্রতিবেদনও জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি।
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়ি সদরের মধুপুর এলাকায় মোটরবাইক চুরির অভিযোগে জনতার পিটুনিতে মামুন নামে এক বাঙালি সেটলার নিহত হন। তার বিরুদ্ধে চুরি ও মাদকের ১৭টি মামলা চলমান ছিল। ওই ঘটনার জেরে পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি ছাত্র পরিষদের ব্যানারে সেটলার বাঙালিরা দীঘিনালা উপজেলায় সমাবেশ করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়। এরপরেই শুরু হয় দফায় দফায় হামলা।
১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় সেটলারদের হামলায় ধন রঞ্জন চাকমা (৫২) নিহত হন এবং আরও চারজন গুরুতর আহত হন। অগ্নিসংযোগে পুড়ে যায় অর্ধশতাধিক দোকান, ২৪টি মোটরবাইক ও অটোরিকশা। প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়। একই দিন রাতে খাগড়াছড়ি সদরে সেনাবাহিনীর গুলিতে জুনান চাকমা (২০) ও রুবেল ত্রিপুরা (৩০) নিহত হন, আহত হন অন্তত ২০ জন ছাত্র–যুবক।
পরদিন ২০ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ির হামলার প্রতিবাদে রাঙ্গামাটিতে জুম্ম ছাত্র–যুব সমাজ শান্তিপূর্ণ মিছিল করে। কিন্তু সেখানে আবারও সেটলার বাঙালিদের হামলা হয়। কাপ্তাই কর্নফুলী সরকারি কলেজের ছাত্র অনিক চাকমাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে হামলাকারীদের স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়।
সেদিন আরও শতাধিক জুম্ম আহত হন। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ২৪টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয় একটি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ বিহারে। ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৫ কোটি টাকা। আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় ও উন্নয়ন বোর্ডের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে আরও ৩–৪ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়।
প্রচণ্ড জনসমালোচনার মুখে অন্তর্বর্তী সরকার ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সাত সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে। তাদের দায়িত্ব ছিল ঘটনার কারণ অনুসন্ধান, দায়ীদের চিহ্নিতকরণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের হামলা ঠেকাতে সুপারিশ প্রণয়ন। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হলেও আজও তা প্রকাশ করা হয়নি।
এই ঘটনায় রাঙ্গামাটির কোতয়ালী থানায় চারটি মামলা দায়ের হয়— একটি অনিক চাকমার পিতা, একটি তার মাতা, একটি আঞ্চলিক পরিষদ এবং একটি পুলিশ কর্তৃক। প্রথম দিকে দুই দফায় সাতজন গ্রেপ্তার হলেও বেশিরভাগই জামিনে মুক্ত হয়ে যায়। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মাত্র পাঁচজনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, এর মধ্যে অনিক চাকমা হত্যা মামলার আসামি মো. রুবেল স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে মামলা সমূহে দুই থেকে তিন হাজার হামলাকারীর নাম উল্লেখ থাকলেও এক বছরের মাথায় মাত্র পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের কথা নিশ্চিত হওয়া উদ্বেগজনক।
ঘটনার পর দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তীব্র নিন্দা জানায়। তারা মনে করে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি ও ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ এক বছর পেরিয়েও বিচার না হওয়া পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আদিবাসী জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।
পাহাড়ে জুম্ম জনগণের উপর এ ধরনের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নতুন নয়। তবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সংঘটিত এই নৃশংস হামলা একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা তুলে ধরে, অন্যদিকে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মধ্যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এক বছর পার হলেও বিচার না হওয়া রাষ্ট্রীয় দায়মুক্তির সংস্কৃতি আরও পোক্ত করছে—যার ফলে ভবিষ্যতে একই ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।