সর্বশেষ

স্বাস্থ্য খাতে আস্থার সংকট

বাজেট বাড়লেও সেবার মানে পিছিয়ে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০০
বাজেট বাড়লেও সেবার মানে পিছিয়ে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ক্রমেই এক গভীর আস্থার সংকটে পড়ছে। সরকারি বাজেট বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বাজার সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের জন্য মানসম্মত ও সাশ্রয়ী চিকিৎসাসেবা এখনো অধরা। ফলে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক রোগী উন্নত চিকিৎসার আশায় বিদেশে যাচ্ছেন। ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫ লাখ বাংলাদেশি রোগী চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। এতে দেশ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩১,০২২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে মোট বাজেটের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের হার মাত্র ৩.৯৩ শতাংশ—দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। মাথাপিছু সরকারি ব্যয় বছরে মাত্র ১,০৭০ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিডিপির মাত্র ০.৬৭ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হওয়ায় রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না।  

 

বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার জনের বিপরীতে হাসপাতালের শয্যা মাত্র ০.৮৮টি, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড তিনটি। প্রতি ৮৩০ জনে একজন ডাক্তার, প্রতি ১১,৫৩১ জনে একজন ডেন্টিস্ট এবং প্রতি ৫৬,৫৯৯ জনে একজন মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছেন। নার্স ও টেকনোলজিস্টের সংকট ভয়াবহ—প্রতি ১০ হাজার জনে নার্সের সংখ্যা ছয়জনেরও কম, যেখানে মানদণ্ড ৭০ জন। ঢাকাকেন্দ্রিক সেবাব্যবস্থা গড়ে ওঠায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠী চরম বৈষম্যের শিকার। দেশের মোট বিশেষায়িত হাসপাতালের ৫৩ শতাংশ ঢাকা বিভাগে, অথচ ৭০ শতাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করেন।  

 

রোগীদের মতে, বিদেশে যাওয়ার প্রধান কারণ চিকিৎসকের অভাব নয়, বরং রোগ নির্ণয়ের ওপর আস্থার সংকট। অপ্রত্যাশিত বিল, গোপন খরচ, নিম্নমানের ওষুধ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রোগীদের আস্থা নষ্ট করছে। ফলে তারা উন্নত ডায়াগনস্টিক সুবিধার জন্য বিদেশমুখী হচ্ছেন।  

 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে চিকিৎসা ব্যয়ের ৭৩-৭৪ শতাংশই রোগীদের নিজ পকেট থেকে দিতে হয়। স্বাস্থ্যবিমার আওতায় রয়েছে মাত্র ২.৫ শতাংশ মানুষ। ফলে একটি গুরুতর রোগ পরিবারকে দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তুলনায় জাপানে আউট-অব-পকেট ব্যয় মাত্র ১১ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ৩০ শতাংশ। বাংলাদেশে তা ৭৪ শতাংশ, কার্যত অনিয়ন্ত্রিত। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর মাত্র ৫২, যেখানে সিঙ্গাপুর ও জাপানের স্কোর ৮০।  

 

স্বাস্থ্যনীতিনির্ধারকরা বলছেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে জরুরি স্বাস্থ্য বাজেট ধাপে ধাপে জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করা। চিকিৎসাসেবার মান মূল্য নির্ধারণ ও বিলিং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীন অ্যাক্রেডিটেশন ও মান নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন, কম খরচের স্বাস্থ্যবিমা চালু, ঢাকার বাইরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে অবকাঠামো উন্নয়ন, ডিজিটাল হেলথ সিস্টেম ও ইউনিক পেশেন্ট আইডি চালু করা জরুরি। প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসকদের জন্য প্রণোদনা ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করাও প্রয়োজন।  

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি এ কে আজাদ খান বলেন, দেশের স্বাস্থ্যসেবায় বেশ কিছু অর্জন রয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে কাঙ্ক্ষিত মান নিশ্চিত করা যায়নি। উন্নত দেশগুলোর মতো নয়, এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

সব খবর