বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে সংসদীয় রাজনীতি পর্যন্ত নারীদের উপস্থিতি বেড়েছে দৃশ্যত। তবু সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও যথেষ্ট আন্তরিক নয়—এমন অভিযোগ তুলছেন নারী অধিকারকর্মীরা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে, যেখানে আগামী সংসদ নির্বাচনে অন্তত পাঁচ শতাংশ আসনে সরাসরি নারী প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কিন্তু ইসলামপন্থি দলগুলো এ নিয়ে প্রকাশ্য অনীহা দেখিয়েছে। বিষয়টি নারী অধিকারকর্মীদের হতাশ করেছে।
ঐকমত্য কমিশনের খসড়ায় যা আছে
ঐকমত্য কমিশনের খসড়ায় বলা হয়েছে, বিদ্যমান ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বহাল থাকবে। একই সঙ্গে সাধারণ নির্বাচনে প্রতিটি রাজনৈতিক দল ৩০০ আসনের অন্তত পাঁচ শতাংশে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেবে। পরবর্তী নির্বাচনে এই হার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হবে। ধীরে ধীরে ৩৩ শতাংশে পৌঁছানোই লক্ষ্য।
তবে ইসলামপন্থি দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস ও নেজামে ইসলামী পার্টি এ প্রস্তাবে দ্বিমত জানিয়েছে। তারা মনে করে, আইনগত বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে নারী প্রার্থী মনোনয়ন নির্ধারণ করা নারীর প্রকৃত অগ্রযাত্রাকে ‘বাধাগ্রস্ত’ করতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপি জানিয়েছে, সংসদে সরাসরি পাঁচ শতাংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়ন দেওয়ার প্রস্তাব তাদের পক্ষ থেকেই এসেছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা চাই এ প্রস্তাব সংবিধানে যুক্ত হোক।”
ইসলামপন্থি দলগুলোর যুক্তি
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, তারা ‘পিআর পদ্ধতির’ (proportional representation) পক্ষে। এ ব্যবস্থায় ন্যায্যতার ভিত্তিতে নারী প্রার্থীর মনোনয়ন সম্ভব হবে। খেলাফতে মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুনতাসির আলী বলেন, “নারীর ক্ষমতায়নে আইনগত কোটা নয়, বরং নিরাপত্তা ও সামাজিক পরিবেশ উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে।”
জামায়াত ইসলামীও সংরক্ষিত আসনের পক্ষে মত দিলেও সরাসরি প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি।
নারী অধিকারকর্মীদের হতাশা
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, “দেশের ৫১ শতাংশ নারী এখনও সংসদে যথাযথ প্রতিনিধিত্ব পান না। রাজনৈতিক দলগুলো ৩৩ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়নে একমত হয়নি—এটি অত্যন্ত হতাশাজনক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা নিত্রা বলেন, “অর্ধেকের বেশি ভোটার নারী হলেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী করার বিষয়ে আন্তরিক নয়। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সরাসরি নির্বাচিত আসন জরুরি।”
কমিশনের সীমাবদ্ধতা ও প্রশ্ন
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপ শেষে ঐকমত্য কমিশনও হতাশা প্রকাশ করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো অনীহা দেখাচ্ছে, তাই এখন আর করার তেমন কিছু নেই।”
তবে প্রশ্ন উঠছে—নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন এ প্রক্রিয়ায় আসলে কী করছে? তারা সংসদে ৩০০ অতিরিক্ত আসনের মধ্যে ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছিল, যা কোনো গুরুত্বই পায়নি। সমালোচকরা বলছেন, এ কমিশনের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই বলেই তারা কার্যত ‘দর্শক’।
এমনকি যেসব নারী নেতা এতদিন সরকারঘনিষ্ঠ হয়ে সংস্কারের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন, তারাও এখন নীরব। সমালোচকদের মতে, শাসকদলীয় সুরে অভ্যস্ত এ শ্রেণির নারী কর্মীরা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সক্রিয় না হয়ে বরং পেছনের সারিতে চলে গেছেন। এর ফলে প্রকৃত নারীবাদী আন্দোলন এক ধরনের নেতৃত্বশূন্যতার মুখে পড়ছে।
সংরক্ষিত আসন বনাম সরাসরি নির্বাচন
সংসদে বর্তমানে ৫০টি নারী আসন রয়েছে, যেগুলো দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে বণ্টন করা হয়। এ ব্যবস্থায় নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ নেই। নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, এই প্রথা নারীদের ‘প্রতিনিধিত্বশীলতা’ তৈরি না করে বরং পুরুষ নেতৃত্বের ‘মনোনীত প্রতিনিধি’ বানিয়ে রাখে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরাসরি ভোটের ধারণা তুললেও রাজনৈতিক দলগুলোর একমত না হওয়ার কারণে তা ঝুলে গেছে।
সামনে পথ কোন দিকে?
সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি, নারীর রাজনৈতিক অধিকার ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন সরাসরি নির্বাচিত অন্তত ১০০ আসনে নারী প্রার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। তাদের মতে, ধাপে ধাপে ৫ বা ১০ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন নারীর রাজনৈতিক অগ্রগতি থামিয়ে দেবে।
ফওজিয়া মোসলেম বলেন, “আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। সভা-সমাবেশ ও সেমিনারের মাধ্যমে নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের কথা বলব। রাজনৈতিক দলগুলোকে জবাবদিহির মুখে ফেলতে হবে।”
বাংলাদেশের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। কিন্তু সংসদে সরাসরি নির্বাচিত নারী সদস্যের সংখ্যা এখনও হতাশাজনকভাবে কম। ইসলামপন্থি দলগুলোর অনীহা, কমিশনের সীমাবদ্ধতা এবং দলীয় রাজনীতির পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা পরিবর্তন না হলে এই বাস্তবতা অচিরেই বদলাবে—এমন আশা করাও কঠিন।