ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক পোশাক শ্রমিককে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। নিহত ব্যক্তির নাম দিপু চন্দ্র দাস (প্রায় ২৮)। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বাসিন্দা এবং ডুবুলিয়া পাইওনিয়ার নিট ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) জানিয়েছে, নিহত দিপু চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ‘নবী ও ধর্ম নিয়ে কটূক্তির’ অভিযোগ তোলা হলেও এখন পর্যন্ত সেই দাবির কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। র্যাবের ময়মনসিংহ কোম্পানি কমান্ডার মো. সামসুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নিহত ব্যক্তি যদি ফেসবুকে কিছু লিখতেন বা কেউ সরাসরি তাকে এমন কথা বলতে শুনতেন, তাহলে বিষয়টি ভিন্ন হতো। কিন্তু আমরা এমন কাউকে পাইনি, যিনি নিজের চোখে বা কানে ধর্ম অবমাননার কিছু দেখেছেন বা শুনেছেন।”
র্যাব ও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর ফ্যাক্টরির ভেতরে কিছু শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে মারধর শুরু করেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে ‘নবীকে কটূক্তি করার’ অভিযোগ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। পরে ফ্যাক্টরির বাইরেও উত্তেজিত জনতা জড়ো হতে থাকে এবং দিপুকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায়।
পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ দিপু চন্দ্র দাসকে বরখাস্ত করে। র্যাবের দাবি, “ফ্যাক্টরি রক্ষার জন্য কর্মকর্তারা ভিকটিমকে বাইরে ঠেলে দেয়।” বিকেল পাঁচটার দিকে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলেও পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয় রাত আটটার দিকে।
ফ্যাক্টরির বাইরে নিয়ে যাওয়ার পর দিপু চন্দ্র দাসকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে নির্মমভাবে মারধর করা হয়। পরে তাকে জামিরদিয়া স্কয়ার মাস্টারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়কের আইল্যান্ডে একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে দড়ি ছিঁড়ে গেলে তার দেহ মাটিতে পড়ে যায়। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। তবে নিহত ব্যক্তি পুলিশের কাছ থেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন এমন দাবি সম্পূর্ণ ‘ভুয়া’ বলে জানিয়েছেন ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমাদের অনেক দেরিতে জানানো হয়েছে। ঘটনাটি ফ্যাক্টরিতেই শুরু হয় এবং সেখান থেকেই তাকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।”
নিহতের চাচাতো ভাই কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, “ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কারা জড়িত। আমার ভাইকে মিথ্যা অভিযোগ তুলে হত্যা করা হয়েছে। আমরা শুধু বিচার চাই।” দিপু চন্দ্র দাস দেড় বছর বয়সী এক কন্যা সন্তানের জনক। কাজের কারণে তিনি পরিবার থেকে আলাদা হয়ে ফ্যাক্টরি এলাকায় একটি মেসে থাকতেন।
এ ঘটনায় র্যাব ভিডিও বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে সাতজনকে আটক করেছে। পুলিশও পৃথকভাবে তিনজনকে আটক করে মামলা দায়ের করেছে।
শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকার এক বিবৃতিতে ঘটনাটির তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”