কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ি জনপদ এখন আতঙ্কের নাম। সন্ধ্যার পর মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
গত রোববার সন্ধ্যায় বাহারছড়া ইউনিয়নের একটি মুদি দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন সতেরো বছর বয়সী মামুন। হঠাৎ পাহাড়ি জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসা আট থেকে দশজন অস্ত্রধারী ডাকাত দোকান ঘিরে ফেলে। তারা টাকা-পয়সা ও মালামাল লুট করে এবং দোকানে উপস্থিত পাঁচ কিশোরকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও চারজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অপহৃত মামুনের বাবা অছিউর রহমান বলেন, “ছেলেটা আমার নিরীহ। তাকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার স্ত্রী নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, দিন-রাত শুধু কান্না করছে।” একই অবস্থা অন্য তিন কিশোরের পরিবারেও।
স্থানীয় বাসিন্দা রিয়াজুল হাসান খোকন জানান, গত ছয় মাসে অন্তত ত্রিশজন শিশু-কিশোর অপহরণের শিকার হয়েছে। প্রতিবারই মুক্তিপণ দিয়ে তাদের ছাড়াতে হয়েছে। তিনি বলেন, “এটা এখন এক আতঙ্কের জনপদ। সন্ধ্যার পর মানুষ ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে।”
অপহৃত আবু বক্কর ছিদ্দিকের বাবা মোহাম্মদ হাসান বলেন, “দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাই। মুক্তিপণের টাকা দেবো কীভাবে?”
অপহৃতদের মধ্যে তেরো বছর বয়সী মোহাম্মদ শাহীন ডাকাত দলের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসে। তার মা ফাতেমা বেগম বলেন, “অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটার সময় কয়েকজন দৌড় দেয়। ডাকাতরা তাদের ধরতে গেলে আমার ছেলে সুযোগ নিয়ে পালিয়ে আসে।”
স্থানীয়রা দাবি করছেন, গত এক বছরে টেকনাফে দুই শতাধিক অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ি এলাকায় ডাকাতদের উৎপাত আগেও ছিল, তবে সম্প্রতি তা বেড়েছে। খোকন বলেন, “গত এক বছরে কমপক্ষে দুইশ মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। ডাকাতি তো নিত্যদিনের ঘটনা।”
বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসনের পক্ষ থেকে শক্ত ব্যবস্থা না নেওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে। অছিউর রহমান বলেন, “একেকটা ঘটনা ঘটার পর তারা দুই-একবার আসে। এরপর আর কোনো খোঁজ থাকে না।” প্রতিকার চেয়ে এলাকাবাসী বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ করেছে। সম্প্রতি তারা রোডব্লক কর্মসূচির ডাক দিয়েছে।
পুলিশও স্বীকার করছে, টেকনাফে ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা বেড়েছে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জায়েদ নূর বলেন, “সমুদ্র ও পাহাড়ের সুযোগ নিয়ে একাধিক ডাকাত দল সক্রিয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও এসব ঘটনায় জড়িত।” তিনি জানান, সেনা-পুলিশ-বিজিবির যৌথ অভিযান চলছে।
তবে পুলিশের দাবি, সব অপহরণ মুক্তিপণের জন্য নয়। অনেক ঘটনার সঙ্গে মাদক ব্যবসার সম্পর্ক রয়েছে। ওসি নূর বলেন, “মাদকের টাকার ভাগাভাগি, দেনা-পাওনা—এমন কারণে বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে। তবে কিছু সত্যিকারের অপহরণও আছে।”
স্থানীয়রা পুলিশের এই দাবি মানতে নারাজ। খোকন বলেন, “অল্প কিছু ঘটনার সঙ্গে মাদকের সম্পর্ক থাকতে পারে। বেশিরভাগই মুক্তিপণের জন্য অপহরণ।”
পুলিশ স্থানীয়দের দেওয়া দুই শতাধিক অপহরণের হিসাব নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। তবে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিতে পারেনি। ওসি নূর বলেন, “অভিযোগ পেলেই তদন্ত করা হয় এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিশোর অপহরণের ঘটনায় টাস্কফোর্স কাজ শুরু করেছে।”
সব মিলিয়ে টেকনাফে পাহাড়ি জনপদ এখন ভয় আর আতঙ্কে আচ্ছন্ন। শিশু-কিশোরদের নিরাপত্তা নিয়ে অভিভাবকরা দিশেহারা। প্রশাসনের উদ্যোগে আস্থাহীনতা বাড়ছে। মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, মাদক ব্যবসার দ্বন্দ্ব এবং দুর্বল আইন প্রয়োগ—সব মিলিয়ে টেকনাফের মানুষ প্রতিদিন নতুন করে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।