সর্বশেষ

ব্যঙ্গ

মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০
মুক্তিযুদ্ধের নয়া বয়ান: জামায়াতের সহীহ ইতিহাস

হে জননেতা, হে প্রজাসাধু! শুনুন শুনুন! আজ হইতে আমাদের পাঠ্যপুস্তক, টেলিভিশন, মসজিদ-মাহফিল ও ঘরে ঘরে ছড়াইয়া পড়িবে এক “নয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস”—সম্পূর্ণ শুদ্ধ সংস্করণ, যাহা জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক প্রণীত।


দীর্ঘ একাত্তরের সেই জ্বলন্ত দিনগুলি? ভুল। বীর মুক্তিযোদ্ধা? ভুল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব? ভুল। এতদিন যাহা আমরা জানিতাম, সবই বিভ্রান্তি, মায়া। তবে দুশ্চিন্তার কারণ নাই, কারণ এখন আমাদের হাতে আসিতেছে সহীহ, হালাল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।
 

প্রথম অধ্যায়ে দেখা যাইবে, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ—যাহা আমরা বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত বলিয়াই জানিতাম—তাহা রচনা করিয়াছেন মতিউর রহমান নিজামী। পল্টনের ময়দানে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ছাত্রসেনার ভলেন্টিয়ার বাহিনী। জনগণকে রুহ আফজা শরবত খাওয়ানো, পান্তা ভাত পরিবেশন- সব আয়োজন পরিচালনা করিয়াছিলেন মাওলানা সাইদীর নেতৃত্বে সেই দিনের ভলেন্টিয়ারবর্গ।
 

স্বাধীনতার ঘোষণার মর্যাদা? ভুলভাবে আমরা জানিতাম। এখন সময় আসিয়াছে শুধরাইয়া নিবার। কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র হইতে মরহুম গোলাম আজম সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১১ সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন জামায়াতে ইসলামী আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ। বীরত্বের ক্রেডিট এখন নতুনভাবে বিতরণ করা হইয়াছে।
 

১৬ ডিসেম্বরের কাহিনী? মনযোগ দিয়ে শুনুন। প্রকৃতপক্ষে নিয়াজীর কাছেই আত্মসমর্পণ করিয়াছেন জগজিৎ সিং আরোরা। যুদ্ধশেষে পাকিস্তানি বাহিনীকে ফুলের মালা দিয়া সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ভারতীয় বাহিনী লাইন ধরিয়া গিয়াছে ভারতে—যেমন একটি পার্কে পিকনিক শেষে সবাই ঘরে ফিরিয়া যায়। এতদিন যাহা আমরা জানিতাম—জয়-পরাজয়, বিন্যাস, দুঃখ-বেদনা—সবই ভুল।
 

এই নতুন “সহীহ ইতিহাস” পাঠ্যপুস্তকে ঢুকিয়া পড়িতেছে যেন কোন ভুল আর মানুষ পড়িতে না পারে। স্কুল-কলেজ হইতে বিশ্ববিদ্যালয়—সকল পাঠ্যক্রম এখন জামায়াত স্বীকৃত, সহীহ ইতিহাস। টেলিভিশনে শুরু হইয়াছে টকশো: “সঠিক ইতিহাস জানুন”—যেকোনো সন্ধ্যায়, যেকোনো চ্যানেলে।
 

ঘরে ঘরে জামায়াতের মহিলা কর্মীরা পৌঁছাইতেছেন, মেহনত করিতেছেন। দাড়িপাল্লা মার্কায় ভোটের দিকনির্দেশ, আসল মুক্তিযোদ্ধা চেনার ফজিলত, মসজিদে মসজিদে বয়ান—সবকিছুতেই আমরা শিখিবো কারা আসল। মানুষ এখন নতুন ইতিহাস জানিয়া যারপরনাই খুশী। আনন্দের ঢেউয়ে মিশিয়া যাইতেছে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। দিকে দিকে মিষ্টি বিতরণ চলিতেছে। প্রতিটি বাড়ি এখন “সহীহ ইতিহাসের পাঠশালা”।
 

রম্য ব্যঙ্গের চামচে কাটা এই নতুন সংস্করণ আমাদের মনে করাইয়া দেয়, ইতিহাস শুধুই ঘটনা নয়, ইহা ধর্ম বিক্রয়ের মাধ্যমও বটে। আর যিনি লিখিতেছেন—তিনিই প্রকৃত দেশপ্রেমিক। অতীতের ভুল সংশোধনের মহতী কাজ শুরু হইয়াছে, জনগণ তাহার অংশ হইতে উৎসাহী। জনগনের ঘরে ভাত নাই, পরায় কাপড় নাই - তাহাতে তাহাদের উদ্বেগের কিছু নাই। বরং জামায়াতের ইতিহাস সংস্কার নিয়া মহতী উদ্যোগেই তাহাদের আনন্দ।
 

কেহ হয়তো বলিবে, “এ তো বড়ই হাস্যকর।” কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এই নতুন ইতিহাসে হাস্যরসও একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। আনন্দে বাঁচয়া থাকিতে হইলে হাস্যরসেরও কমতি থাক চলিবেনা। সকলে মিলিয়া হাসি, মিষ্টি খাই এবং প্রতিটি ঘরে ঘরে ইতিহাস ছড়াইয়া দেই।
 

অতএব, প্রজাসাধু, ধ্যান করুন। এখন থেকে আমরা জানিব—মুক্তিযুদ্ধ একটি সহীহ, হাস্যরসপূর্ণ শিক্ষা, যাহা জামায়াত আমাদের পৌঁছাইয়া দিতেছে। ঘরে ঘরে, মসজিদে-মসজিদে, প্রতিটি শিশু ও বৃদ্ধ—সবাই এখন “সহীহ ইতিহাস” জানে।
 

মহান মুক্তিযুদ্ধের এই নয়া অধ্যায় পড়ুন, শুনুন, উপভোগ করুন।

 

লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - বর্তমানের রঙ্গমঞ্চে দন্ডায়মান এক ভাঁড়

সব খবর

আরও পড়ুন

যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

বুদ্ধিজীবী দিবসে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতি যে ইতিহাস শিক্ষক জানতেন পাকিস্তান টিকবে না

ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

মতামত ডিসেম্বরের কাছে ফিরে যাওয়া: তরুণদের বাংলাদেশ ও এক অসমাপ্ত স্বপ্ন

হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস : বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হাত-পা বাঁধা লাশ, অশ্রুসিক্ত বিজয়—জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা

শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

রঙতুলির বিদ্রোহ শিল্পীর রেখায় মুক্তির স্বপ্ন

নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

মানবাধিকার সংকটের নতুন আতঙ্ক নিখোঁজ এস এম কামরুজ্জামান সাগরকে ঘিরে উদ্ভূত উদ্বেগ ও জাতির দায়বদ্ধতা

ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

ব্যঙ্গ কলাম ডিসেম্বর আসিলেই যাহাদের চুলকানি বাড়ে

তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?

মতামত তারেক জিয়ার ঘরে ফেরা নিয়ে কেন এত অনিশ্চয়তা?

ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক

ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারির ৮ কিংবা ১৪ তারিখ নিয়ে গুঞ্জন, অন্তর্ভুক্তিমূলক হওয়ার প্রশ্নে বাড়ছে জাতীয় বিতর্ক