ডিসেম্বর আসিলেই আমাদের দেশে এক অদ্ভুত রোগবালাই মাথা তুলিয়া ওঠে। রোগটি কোনো জৈবিক ব্যাধি নয়, বরং রাজনৈতিক আবহে জন্ম নেওয়া এক মনস্তাত্ত্বিক জ্বর। এই রোগে আক্রান্ত লোকেরা হঠাৎ করিয়াই অতীতকে নতুনভাবে রচনা করে, সংখ্যাকে কাব্য বানায় এবং ইতিহাসকে বাজারে বিক্রির পণ্য ভাবিয়া ফেলে। সাধু ভাষায় বলি—ইহারা ইতিহাসের দোকানদার আর ডিসেম্বর তাহাদের বার্ষিক হালখাতার সিজন।
প্রথম লক্ষণ হইল ইতিহাসচর্চার অতিরঞ্জন। মহান মুক্তিযুদ্ধ হইতে শুরু করিয়া শহীদগণের সংখ্যা, মাতৃভূমির মর্যাদা—সবকিছুই ইহাদের কণ্ঠে নিত্যনতুন রূপ পায়। ত্রিশ লক্ষ না ত্রিশ হাজার—সংখ্যা যখন রাজনৈতিক কৌতুকের খেলা হয়, তখন গণিতও লজ্জায় লাল হইয়া যায়। ইহারা ইতিহাসকে এমনভাবে কুঁচকায়, যেন ইতিহাসই তাহাদের পোষাক; পোষাক বদলাইলে ইতিহাসও বদলিয়া যাবে—এই বিশ্বাসে তাহারা অনড়।
দ্বিতীয় লক্ষণ হইল পতাকা-দর্শনাত্মক প্রতিক্রিয়া। লাল-সবুজ পতাকা দেখিলেই ইহাদের চোখে অদ্ভুত অবসন্নতা, কণ্ঠে মৃয়মানতা। তাহারা বলে—দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ। অথচ যখন কাজের কথা আসে, তখন তাহারা ভাষাহীন, মূক, বধির। সাধু বলি—দেশপ্রেম যদি বাজারে বিক্রয়যোগ্য বস্তু হইত, তবে ইহারা নিশ্চয়ই বড় ব্যবসায়ী হইতেন।
শারীরিক প্রতিক্রিয়াও অদ্ভুত। ডিসেম্বর আসিলেই ইহাদের খাবারে অরুচি দেখা যায়; পেটে গ্যাস হয়, মাথা ভারি লাগে, চোখ লাল হয়—কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়। তাহারা একে অন্যকে দেখিয়া বলে—“এ তো শুধু ডিসেম্বরের রোগ, পার করিলে বাঁচিব।” কিন্তু সমস্যা হইল, বছরের বাকি এগারো মাসে তাহাদের চুলকানি, খুঁজলি, পাঁচড়ির কোন লক্ষণ দৃশ্যমান হয়না। সারাবছর যখন মঞ্চে উঠে ইহারা কৌতুক করে, হিন্দি গানের সুরে গজল গায়, তখন সাধারণ মানুষ ভাবে, মনে হয় রোগ সারিয়াছে। কিন্তু কিসের কী, ডিসেম্বর আসিলেই আবার।
চিকিৎসা শাস্ত্রের পন্ডিতগণ ইহাদের নিয়া গবেষণা করিয়া কোন কূল কিনারা পান না। ইহা মহামারি নহে, কারণ আপামর জনসাধারণের মধ্যে এই রোগের কোন প্রাদূর্ভাব নাই। শুধু বিশেষ দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে ইহা সংক্রামক।
চর্ম চিকিৎসক গণ বলেন- ইহা মানসিক সমস্যা, চিকিৎসার এখতিয়ার আমার নহে। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানীরা তাহাদের বল যৌণ চিকিৎসকের কোর্টে ঠেলিয়া দিয়া বলে - ইহা গণোরিয়া, গণভাবে দলীয় কর্মীরা আক্রান্ত হইবার লক্ষণ।
কারওয়ান বাজারের চর্ম ঔষুধের জনৈক বিক্রেতা বলেন, ইহা অতিসয় প্রাচীন চুলকানি, দাউদ, একজিমা। ইহা খাউজাইয়া খাউজাইয়া রোগীরা ঘাউ বানাইয়া ফালায়। ফলে সর্বাঙ্গে পাগলা মলম না মাখিলে উপায় নাই।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, ইহাদের সমাজচ্যূত করিয়া আলাদা দ্বীপে দীপান্তর করিয়া কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা যাইতে পারে। সেখানে হিন্দি সিনেমা ও গানের সরবরাহ ঠিক থাকিলে ইহারা ভালো থাকিতে পারিবেন।
ইহাদের নিয়া সমাজ চিন্তিত, দেশবাসী চিন্তিত, সরকার চিন্তিত। মূল চিন্তার কারণ, এই রোগের কোন নামই এখনো খুঁজিয়া পাওয়া যায়নাই। কেহ বলেন ডিসেম্বারোফোবিয়া, কেহ বলেন রাজাকারোসাইটিস, কেহ বা বলেন জামাতোরিয়া। নাম যাই হোক, ইহার উপশমে কোন বিদ্যা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নাই। তবে, কোন কোন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়াছেন, ইহাদের সামনে লাল সবুজ পতাকা না ধরিলে, দেশের গান না চালাইয়া হিন্দি গান চালাইলে, ইহাদের রাজাকার না বলিলে এ রোগের লক্ষণ কম দৃশ্যমান হয়।
ইহা মানিলে সমাজবিজ্ঞানীদের পরামর্শই কার্যকর সহজ বলিয়া বোধ হয়। ইহাদের আন্দামান দ্বীপে পাঠানো হউক। সেইখানে কালাপানি পার হইয়া সাগরের নোনাজল খাইয়া শরীরে বল পাইবে, হিন্দী গানের মাধুর্য আর রশ্মিকা মান্দালার সাথে মার ডালা গান গাইতে গাইতে জীবন পার করিবে। দেশ ও দশের জন্য ইহাই মঙ্গল।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - বালা মুসিবত হইতে মুক্তি চাহিয়া প্রার্থনায় রত