যেই ইলিশ, সেই রাজনীতি। যেই মাছ, সেই মিত্রতা। সরকার বাহাদুর সদ্য ১২০০ টন ইলিশ ভারতে পাঠাইবার মহৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। ইহা কেবল রপ্তানি নহে, ইহা এক পরম বন্ধুত্বের কাব্য, এক কূটনৈতিক কাবিননামা, যাহা স্বাক্ষরিত হইয়াছে পদ্মার পেট থেকে উঠে আসা রূপালি মাছের আঁশে আঁশে।
ভারত, যাহা এতকাল ছিল শত্রু রাষ্ট্র, হঠাৎ করিয়া আবেগে উদ্বেলিত হইয়া বলিয়াছে, “বাংলাদেশ, তুমি ইলিশ দিলে, আমরা হৃদয় দিলাম।” অতএব, গত এক বছরে যেইসব অভিযোগ উঠিয়াছিল—২৬ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক আমাদের সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়া সার্বভৌমত্বের গলা টিপিয়া ধরিয়াছিল, ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, সেইসব অভিযোগ এখন ইলিশের তেলে ভাজিয়া খাওয়া হইয়াছে।
চোখে চোখ রাখা, ঘাড় সোজা করা, মেরুদণ্ডের বক্রতা—এই সকল শারীরিক ও কূটনৈতিক সমস্যার সমাধান এখন ইলিশ-চিকিৎসায় সম্ভব। পদ্মার ইলিশে আছে এমন এক অলৌকিক গুণ, যাহা ভারতীয় কূটনীতিকদের হৃদয় গলাইয়া ফেলিয়াছে। তারা বলিয়াছে, “বাংলাদেশ, তুমি আমাদের ইলিশ দিলে, আমরা তোমার সকল দাবি মেনে নিলাম। সীমান্তে আর গুলি চলিবে না, নদীর পানি তোমার, চুক্তি তোমার, ভালোবাসাও তোমার।”
এতদিন যেইসব অবৈধ চুক্তি ছিল, যাহা দেশবিরোধী বলিয়া চিৎকার করিয়াছিলাম, তাহা এখন বৈধ হইয়াছে। কারণ, ইলিশ গিয়াছে। দেশপ্রেমের কাবিননামা স্বাক্ষরিত হইয়াছে। আমরা এখন ভারতকে বলি “পরম বন্ধু”, আর তারা আমাদের বলে “ইলিশ-দাতা ভাই”।
আমরা নিজের দেশে ২৫০০ টাকা কেজিতে ইলিশ কিনিয়া খাইতে পারি না, কিন্তু পরম শুভাকাঙ্খি ভারতকে ১৫০০ টাকায় উপহার দিই। কারণ, বন্ধুত্বে লাভ-ক্ষতি নাই। ইহা এক আত্মত্যাগ, এক আত্মসমর্পণ, যাহা কেবল মহান জাতিই করিতে পারে।
দেশপ্রেমিকগণ যাহারা এতকাল ভারত-বিরোধী স্লোগান দিয়া গলা ফাটাইয়াছিলেন, তাহারা এখন ইলিশের গন্ধে মোহিত হইয়া বলিতেছেন, “ভারত আমাদের ভাই, ইলিশ আমাদের সেতু।” ইহা হইল সেই সেতু, যাহা পদ্মা নদীর উপর নহে, হৃদয়ের উপর নির্মিত।
অতএব, ইলিশ রপ্তানির মাধ্যমে আমরা কূটনীতি, অর্থনীতি, ভূ-রাজনীতি, এবং হৃদয়নীতি—সবকিছুর সমাধান করিয়াছি। ইলিশ এখন কেবল মাছ নহে, ইহা এক আদর্শ, এক দর্শন, এক পরম বন্ধুত্বের প্রতীক।
জয় হোক ইলিশের, জয় হোক রপ্তানির, জয় হোক সেই বন্ধুত্বের, যাহা মাছের আঁশে বাঁধা। সরকার বাহাদুরের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে আমরা গর্বিত, আমরা মোহিত, আমরা... ক্ষুধার্ত। কারণ, ইলিশ তো গেল, কিন্তু পাতিলে এখন শুধু পানি।
লেখক: এক ক্লান্ত পেনসিল - যে তাহার প্রতারিত সময়কে বঞ্চনার কালিতে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখে