“মগের মুল্লুক” একটি বাংলা বাগধারা; যার অর্থ বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বা অরাজক পরিস্থিতি। এই বাগধারাটি এসেছে পঞ্চদশ শতাব্দীতে আরাকান থেকে আসা মগ জলদস্যুদের অত্যাচারের ইতিহাস থেকে, যারা বাংলা অঞ্চলে লুটপাট চালাত এবং এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত যা “যা খুশি তাই করার দেশ” বোঝাতে ব্যবহৃত হতো।
কিন্তু সম্প্রতি মেটিকুলাসলি ডিজাইনড জুলাই আন্দোলনের পর থেকে বাগধারাটি বদলে গেছে। অর্থাৎ “মগের মুল্লুক” বাগধারাটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে “মবের মুল্লুক”।
বিগত সরকার পতনের পর থেকেই এই বাংলা দেশে আরাকান থেকে আসা মগ জলদস্যুদের লুটপাটের কায়দায়ই চলছে সবকিছু। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনিই খবরের কাগজে লাশের মিছিল। হত্যা, ধর্ষণ, খুন - এসব খবরে পত্রিকার কাটতি ভালো হচ্ছে কি না, সেটা পত্রিকাওয়ালারাই ভালো জানেন। তবে আমরা জানি, অন্তর্বর্তী সরকার নামক একটি সরকার এই বাংলা দেশে থাকলেও “মবের মুল্লুক” সরকারের চাইতে বেশি কার্যকর। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি এই ‘মব ভায়োলেন্স’ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? নাকি সরকারই গোপনভাবে উসকে দিচ্ছে এই ‘মব ভায়োলেন্স’?
অন্যদিকে, আরাকান জলদস্যুদের এই বাংলায় অত্যাচারের ইতিহাস। সেটিও যেন পুনরায় সামনে এসেছে। বেশ ক’দিন থেকেই কক্সবাজার, সেন্টমার্টিনের নিকটতম সমুদ্র উপকূল থেকে বাংলাদেশি জেলেদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি - এসব খবর সামনে আসছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর, বুধবার খবর আসে কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের নিকটবর্তী সাগর থেকে পাঁচটি মাছ ধরার ট্রলারসহ অন্তত ৪০ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। এর আগে গত ২ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার ১৮ জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব অপহরণ হওয়া জেলেরা কি ফিরে আসছেন, এইসব জেলে পরিবারের খবর নিচ্ছে কি সরকার?
তাহলে, সেই পুরোনো কায়দায় মগ জলদস্যুরা ফিরে এসেছে আরাকান আর্মি হয়ে এই বাংলায় লুটপাট করতে? আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘মব ভায়োলেন্স’। চলছে চুরির অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা। পোশাক বা অন্য কোনো অজুহাতে নারী হেনস্তা। ধর্ম অবমাননার অভিযোগে লাশ পোড়ানো। মব বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার নৈরাজ্যে প্রতিদিনিই মানুষ মরছে অহরহ। জনমনে প্রশ্ন, তাহলে কি মবের মুল্লুকে পরিণত হয়েছে এই বাংলা?
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন, মব ঠেকানো যাচ্ছে না, নাকি ঠেকানো হচ্ছে না? তারা বলছেন, মব তৈরি করে সমাজে ভয় চালু করা হচ্ছে। কারণ পুলিশের সামনেই কিংবা অনেক সময় পুলিশের বিরুদ্ধেই মবের ঘটনা ঘটছে। যদি পুলিশের বিরুদ্ধেই মবের ঘটনা ঘটে, তবে এই ঘটনাগুলো ঠেকাবে কে?
ভোলায় নারীকে চুল কেটে জুতার মালা পরানো, নুরাল পাগলার লাশ পোড়ানো, চুরির অপবাদ দিয়ে রংপুরে ভ্যান চালককে পিটিয়ে হত্যা। এমনকি একাত্তর ও সংবিধান নিয়ে আলোচনা সভায় মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকীকে হয়রানি। একের পর মবের ঘটনায় সরকারসহ সব পক্ষ বারবার কাগুজে বিবৃতি আর কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু থামছে না মব।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত এক বছরের হিসাবে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত ১৯৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে মব সৃষ্টি করে। এ সময়ে শুধু ঢাকা বিভাগেই এধরণের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯২ জন। গেলো এক বছরে সব মিলিয়ে ৬৩৭ জন বিক্ষিপ্তভাবে উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রোশের শিকার হয়েছে।
অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, মব হলো আইনের বাইরে গিয়ে, বিচার বহির্ভূতভাবে কাউকে হেনস্তা করা বা আক্রমণ করা, কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাউকে ভয় দেখানো। মব সন্ত্রাস কয়েক ধরনের । কোনো প্রতিষ্ঠান দখল করতে হলে মব তৈরি করা হয়, তেমনি কাউকে ট্যাগ দিতে হবে বা কোনো পদ দখল করতে হবে তখনও মব সৃষ্ট করা হচ্ছে। সেখানে কতজন ছিলো সেটি গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো এর উদ্দেশ্য, সেটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত একটা অস্ত্র।
জনমনে প্রশ্ন, তাহলে বর্তমান অন্তর্ববর্তী সরকার কী রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে মব ভায়োলেন্সকে প্রশ্রয় দিচ্ছে? কেন আরাকান আর্মিরা জেলেদের তুলে নিয়ে গেলেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না?