বলা হয়ে থাকে শয়তানের জন্য কারাগার রমজান মাস আর রাজাকারদের জন্য ডিসেম্বর! আর এবার নয়া বন্দোবস্তের বাংলাদেশে রাজাকাররাই নেতৃত্ব দিলো দেশ জুড়ে উদযাপিত বিজয় দিবসের। জামাতে ইসলামি এবার এতটা ঔদ্ধত্য ও আড়ম্বরপূর্ণ বিজয় উৎসব উদযাপন করেছে যা দেখে লজ্জা, ঘৃণা অপমানে চুপসে ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আপমর জনতা।
জামাত এবার জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই বিজয় উৎসব উদযাপন করেছে অভাবনীয় কৌশলে। জামাতের আমীরের নেতৃত্বে বিশাল বিজয় ম্যারাথন, সাইকেল শোভাযাত্রা সবার নজর কেড়েছে। যদিও অনেকে ট্রোল করেছে ৭১ এ তারা যেভাবে দৌড়ের উপর ছিল তারই স্মরণে এই বিজয় ম্যারাথন। কিন্তু তাদের এই বর্ণিল ম্যারাথন ইতিহাসের উল্টোচাকাকে আরও গতিশীল করেছে।
জামাতের আমীর ডা. শফিক একটা হুডখোলা গাড়িতে দাঁড়িয়ে এই ম্যারাথনের নেতৃত্ব দিয়েছে, সাথে ছিল হাজার হাজার লাল সবুজ ক্যাপ পড়া রাজাকার ও তাদের শাবকরা। শিবিরের উদ্যোগে সাইকেল শোভাযাত্রা হয়েছে রাজধানীতে। ঢাকা কলেজ ছাত্র শিবির এই সাইকেল শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে।
এবার জলপথেও তাদের সরব ও বর্ণিল আস্ফলন আমরা দেখলাম। যে বুড়িগঙ্গা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নীরব এক বহতা স্মারক। হাজার হাজার শহীদের রক্তস্রোত গিয়ে মিশেছিল এই বুড়িগঙ্গায়। কত লাশের সলিল সমাধি হয়েছে এই নদীতে তা আজও অজনা। এই বুড়িগঙ্গার বুকেই ৭১ এর ঘাতকদের উত্তর প্রজন্ম আজ সদর্পে আয়োজন করেছে নৌ শোভাযাত্রার। শিবির কেন্দ্রীয়ভাবে কয়েক ডজন নৌকায় লাল সবুজের পোশাক আর পতাকা উড়িয়ে বুড়িগঙ্গার বুকে উদযাপন করেছে এই নৌ শোভাযাত্রার।
তবে এবার সবচেয়ে অবাক করেছে সশস্ত্র বাহিনীর আকাশ পথে বিজয় উদযাপন। আশিকে পাকিস্তান, বিডা চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদসহ সশস্ত্র বাহিনীর ৫৪ জন প্যারা ট্রুপার একযোগে আল্লাহু আকবর বলে জাতীয় পতাকা হাতে ফ্রি ফল জাম্পিং করে রেকর্ড করেছে। বিজয় দিবসে পতাকা হাতে ফ্রি ফল প্যারা ট্রুপিং করে রেকর্ড করা নিঃসন্দেহে গৌরবময়। কিন্তু জলে, স্থলে জামাত যেভাবে বিজয় শোভাযাত্রা করেছে আকাশে তো সেটা সম্ভব নয়, কেননা আয়োজন তো সশস্ত্র বাহিনীর। কিন্তু জামাতি কৌশল এখানেও সফল। যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেই জয় বাংলা স্লোগান মুছে দিয়ে জামাতিদের স্লোগান নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবর বলেই ঝাঁপ দিয়েছে সকল প্যারা ট্রুপার।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে বিনা বাঁধায় সদম্ভে উদযাপন করেছে এবারের বিজয় দিবস। স্থলে তারা দেশ জুড়ে একক নেতৃত্বে ইতিহাসের উল্টোধারায় উদযাপন করেছে বিজয় উৎসব। প্রায় সকল জেলা-উপজেলা প্রশাসন বিজয়ের যে আয়োজন করেছে তাতে একাত্তরের পরাজিত শক্তির ছিল একক কর্তৃত্ব, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে ভুলন্ঠিত করেছে সর্বত্র।
খুব সামান্যই প্রতিবাদ হয়েছে দেশ জুড়ে। রামগতিতে ‘একাত্তরের রাজাকার দ্বারা ধর্ষিতা নারীর অভিনয়’ প্রদর্শণকালে জামাতের নেতৃবৃন্দের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে নারী ইউএনও কে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে গোলাম আজম, নিজামীকে স্বাধীনতার সূর্যসন্তান হিসেবে স্মরণ করতে গেলে উপস্থিত দর্শকরা অনুষ্ঠান পন্ড করে। জগন্নাথ হলে রাস্তায় রাজাকারদের ছবি আঁকলে প্রক্টরিয়াল টিম তা মুছে দেয়। তবে ঘৃণা স্তম্ভে জুতা নিক্ষেপ হয়েছে কিছুক্ষণ।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথে পাকিস্তানী পতাকা আঁকায় বাঁধা দেয় শিবির ও প্রক্টরিয়াল টিম। কাদেরিয়া বাহিনীর বিজয় দিবস উদযাপন ও আরও দু'এক জায়গায় খুবই ক্ষীণ স্বরে উচ্চারিত হয়েছে জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধুর নাম। আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন খুবই সতকর্তায় কিন্তু সাহসিকতার সাথে কিছু জায়গায় বিজয় দিবস উদযাপন করেছে। কিন্তু দেশময় বিজয় দিবস উদযাপনের মূল ধারায় মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু নাম ও জয় বাংলা স্লোগান ছিল নিষিদ্ধ। নয়া বন্দোবস্তের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্লোগান ‘জয় বাংলা’র স্থলে প্রতিস্থাপিত হয়েছে ইনকিলাব-জিন্দাবাদ আর নারায়ে তাকবীর।
বিজয় মাসের শুরুতেই ইলিয়াসের ‘বালের বিজয় দিবস’; মাওলানা ইব্রাহীমের ‘মুক্তিযোদ্ধারা সবচেয়ে কুলাঙ্গার প্রজন্ম’; জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ’; চবি উপাচার্য অধ্যাপক শামীম উদ্দিনের ‘পাকিস্তানী বাহিনী দ্বারা বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টি অবান্তর’
....এমনতর অজস্র বয়ান- বিজয়ের ৫৪ বছর পর, নয়া বন্দোবস্তের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের উল্টো ইতিহাস প্রতিষ্ঠার স্পর্ধিত আস্ফলন। এই আস্ফলনই এক গভীর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশকে। এই অন্ধকার যাত্রা প্রতিরোধে আজ সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়া লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হবে।