সর্বশেষ

মতামত

সত্যের চলচ্চিত্র ও ভয়ের রাষ্ট্র

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৩০
সত্যের চলচ্চিত্র ও ভয়ের রাষ্ট্র

ইরানের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহি আবারও রাষ্ট্রীয় দমন–পীড়নের মুখে পড়েছেন। তাঁর নতুন চলচ্চিত্র ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ নির্মাণের পর তেহরানের বিপ্লবী আদালত ‘রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা’র অভিযোগে তাঁর অনুপস্থিতিতে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। পাশাপাশি দুই বছরের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এবং রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনে যুক্ত হওয়ার ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

 

জাফর পানাহিকে বিগত কয়েক দশকে বহুবারই চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রকাশ, আন্তর্জাতিক উৎসবে অংশগ্রহণ এবং বিদেশ যাত্রায় বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ইরান সরকার তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া, সম্পাদনা, এমনকি বিদেশে প্রদর্শন সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। রাজনৈতিক চাপ, আইনগত হুমকি ও প্রশাসনিক জটিলতার মধ্য দিয়ে তাঁকে সবসময় একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কাজ করতে হয়েছে। ফলে একজন শিল্পী হিসেবে তাঁর সৃজনশীল স্বাধীনতা বারবারই ক্ষুণ্ন হয়েছে।

 

পানাহি একাধিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, “তিনি প্রায়ই অনুভব করেন যে ইরানে শিল্পচর্চা মানে যেন অদৃশ্য এক দেয়ালের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করা। তাঁর ভাষায়- তিনি যেসব চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান, সেগুলো সবসময় স্বাধীনভাবে সম্ভব হয় না; প্রতিটি দৃশ্য যেন লুকিয়ে, সতর্ক থেকে তৈরি করতে হয়।” রাষ্ট্রীয় চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্যকে পর্দায় তুলে ধরার এই সাহসই তাঁকে বারবার সরকার সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে।  

 

গোপনে সরকারি অনুমতি ছাড়া নির্মিত ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু  রাজনৈতিক বন্দিদের স্মৃতি ও নির্যাতনের গল্প। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারই এখানে মূল ইস্যু। তাই এই রায় কেবল একটি আইনি সিদ্ধান্ত নয় বরং শিল্পকে নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রচেষ্টা। পানাহিকে শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেই পুরোনো সত্য আবার স্পষ্ট হলো যে চলচ্চিত্র কেবল বিনোদন নয় এটি ক্ষমতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী সাংস্কৃতিক মাধ্যম। তাই প্রায় সব কর্তৃত্ববাদী সরকারই চলচ্চিত্র-কে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।  

 

ইরানে রাজনৈতিক হয়রানি নতুন কিছু নয়। পানাহির সহকর্মী বিখ্যাত নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর চলচ্চিত্র ‘দেয়ার ইজ নো এভিল’ নির্মাণের পর তাঁকে দেশত্যাগে বাধা দেওয়া হয়। এই চলচ্চিত্র মৃত্যুদণ্ড নীতিকে প্রশ্ন করায় ইরানে প্রদর্শন নিষিদ্ধ। ইরানি-ফরাসি নির্মাতা মারজানে শতরাপির গ্রাফিক নভেল অবলম্বনে নির্মিত ‘পারসেপোলিস’ অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্রটি ইরানে পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কারণ এটি ইসলামি বিপ্লব পরবর্তী দমন-পীড়নের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। 

 

অন্যদিকে মাজিদ মাজিদিকে সেন্সরশিপের চাপ এবং রাজনৈতিক ‘অবাধ্যতা’র অভিযোগে বছরের পর বছর চলচ্চিত্র নির্মাণে বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশ্বখ্যাত নির্মাতা আব্বাস কিয়ারোস্তামি রাজনৈতিকভাবে পানাহি’র মতো সরাসরি আক্রান্ত না হলেও প্রায় এক দশক ধরে তাঁর অনেক চলচ্চিত্রই ইরানে সরকারি অনীহা ও সেন্সরশিপের চাপে নিষিদ্ধ হয়। তাঁর আন্তর্জাতিক সাফল্য দেশীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ‘অতিরিক্ত স্বাধীন’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে কুর্দি নির্মাতা বাহমান ঘোবাদি যুদ্ধপরবর্তী মানবিক সংকট তুলে ধরায় ‘টার্টলস ক্যান ফ্লাই’–এর মতো চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ হতে দেখেছেন এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

 

রাকশন বানিয়েতেমাদের সামাজিক–রাজনৈতিক ছবিগুলোও নিয়মিত সেন্সরে আটকে থাকে। এমনকি আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান অভিনেত্রী জাহরা আমির এব্রাহিমি ব্যক্তিগত বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে অস্বীকার করলেই ভয়, শাস্তি ও হুমকি যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। ইরানের চলচ্চিত্র নির্মাণ এখনও খুবই নিয়ন্ত্রিত; নতুন প্রজন্মের সমাজ ও দর্শকদের দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন শুরু হলেও পুরনো নিয়ম, ধর্মীয় গঠন ও রাষ্ট্রীয় আইন এখনও শক্তিশালী।

 

এই প্রবণতা শুধু ইরানে নয় ইতিহাসজুড়ে দেখা গেছে। যে মুহূর্তে কোনো শিল্পী রাষ্ট্রীয় সত্যের বাইরে অন্য সত্য প্রকাশ করেছেন তখনই সেই শিল্পী হয়ে ওঠেন ‘অপরাধী’। সোভিয়েত ইউনিয়নে তারকোভস্কি’র চলচ্চিত্র ‘আন্দ্রেই রুবলেভ’, চীনের বিখ্যাত নির্মাতা জিয়া ঝাংক-এর ‘আ টাচ অব সিন’ দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ছিল। রাজনৈতিক সংবেদনশীল বিষয় দেখালে দেশত্যাগে বাধা, সেন্সরশিপ ও নজরদারি সাধারণ ঘটনা। তুরস্কের নির্মাতা ইলমাজ গুন ও ফাতিহ আকিন প্রায়ই রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়েছেন। কুর্দি ইস্যু দেখালে সেন্সরশিপ ও মামলা অত্যন্ত সাধারণ। কিংবা মিসরে রাজনৈতিক–ধর্মীয় সমালোচনামূলক চলচ্চিত্র সবই একই বাস্তবতার শিকার। এখানে চলচ্চিত্রে নির্মাতাদের বিরুদ্ধে ‘অবমাননা’ মামলার বহর আছে।

 

এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা বা রাষ্ট্রের ‘ইমেজ’ বিরোধী ইস্যু দেখালে চলচ্চিত্র আটকে যাওয়ার অসংখ্য নজির আছে। কারণ রাষ্ট্র সবসময়ই চায়, তার নির্ধারিত সত্যের বাইরে অন্য কোনো সত্য যেন জনপরিসরে দৃশ্যমান না হয়। ভারতে জরুরি অবস্থা চলাকালীন অসংখ্য চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, ধর্মীয় অনুভূতির অজুহাতে নির্মাতারা হয়রানির মুখোমুখিও হচ্ছেন। বাংলাদেশে সেন্সর বোর্ডের অনুমতি না পেলে চলচ্চিত্র আটকে থাকে। সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নির্মাতারা অনেকসময়ই পরোক্ষ চাপ বা নির্দেশের মুখে পড়েন। ‘রানা প্লাজা’ চলচ্চিত্র দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ। প্রায় এক দশক ধরে সেন্সরে আটকে আছে চাকমা ভাষার চলচ্চিত্র ‘মাই বাইসাইকেল’।

 

চলচ্চিত্রকে ‘ক্ষমতা’ ভয় পায়। কারণ এটি কেবল বিনোদন নয় এটি একটি তীক্ষ্ণ সাংস্কৃতিক ভাষা। উপলব্ধি, কল্পনা, প্রতিবাদ এবং মানবিক বেদনা যখন পর্দায় উঠে আসে তখন তা যে কোনো বক্তৃতার থেকেও বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাই বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রথম শিকার হয় চলচ্চিত্র নির্মাতা।

 

পরিচালক জাফর পানাহি’র কাজ সেই দীর্ঘ বিশ্ব ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা। ‘ট্যাক্সি’, ‘দিস ইজ  নট আ ফিল্ম’ কিংবা সাম্প্রতিক ‘ইট ওয়াজ জাস্ট অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট’ প্রতিটি চলচ্চিত্রেই সাধারণ মানুষের বেদনা, অবদমিত কণ্ঠস্বর এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সীমাবদ্ধতা উঠে এসেছে। তাঁকে দমন করা মানে তাঁর বক্তব্যকে দমন করা আর সেই ভাষাই ক্ষমতাকে সবচেয়ে বেশি অস্থির করে।

 

এই দমন-পীড়ন আমাদের মনে করিয়ে দেয় শিল্পীর সৃজনশীল স্বাধীনতা সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও পানাহি নির্ভীকভাবে সত্যকে পর্দায় তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন ভয়, নিষেধাজ্ঞা বা রাজনৈতিক প্রতিশোধ কোনো কিছুই সত্যের ভাষাকে থামাতে পারে না। তাঁর চলচ্চিত্র প্রমাণ করে সত্য, কষ্ট ও নিপীড়নের গল্পই শেষ পর্যন্ত দর্শকের বিবেককে স্পর্শ করে।

 

তাই পানাহি’র এই শাস্তি আবার প্রশ্ন তুলছে শিল্প কি শুধু বিনোদন? নাকি এটি সময়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিবাদ, উপলব্ধি, ন্যায়বিচার ও মানবিক ঐক্যের ভাষা? এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে। রাষ্ট্রের দমন-পীড়ন যতই বাড়ুক, শেষ পর্যন্ত শিল্পের সত্যই মানুষের বিবেককে আন্দোলিত করে; এ কথাই হয়তো আবার মনে করিয়ে দিলেন জাফর পানাহি।

সব খবর

আরও পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের ‘স্মৃতির বিজয় ২০২৫’ আয়োজন

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের ‘স্মৃতির বিজয় ২০২৫’ আয়োজন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নতুন কমিটি গঠন

সভাপতি রেহনুমা, সাধারণ সম্পাদক সুমন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদের নতুন কমিটি গঠন

নীরব অন্তর্দৃষ্টি ও সুরেলা বাস্তবতার এক চলচ্চিত্রকার

হীরেন নাগ নীরব অন্তর্দৃষ্টি ও সুরেলা বাস্তবতার এক চলচ্চিত্রকার

অনন্তযাত্রায় বলিউডের ‘হি-ম্যান’ ধর্মেন্দ্র

মুম্বাইতে শেষকৃত্য সম্পন্ন অনন্তযাত্রায় বলিউডের ‘হি-ম্যান’ ধর্মেন্দ্র

শাকিব খানের ‘প্রিন্স’-এ কলকাতার নায়িকা জ্যোতির্ময়ী কুণ্ডু

মুক্তি পাবে আগামী ঈদে শাকিব খানের ‘প্রিন্স’-এ কলকাতার নায়িকা জ্যোতির্ময়ী কুণ্ডু

‘চাঁদের আলো’ নির্মাতা শেখ নজরুল ইসলাম আর নেই

‘চাঁদের আলো’ নির্মাতা শেখ নজরুল ইসলাম আর নেই

ঋত্বিককে বাংলাদেশের ভালোবাসতেই হবে!

জন্মশতবর্ষে ঋত্বিক ঘটক ঋত্বিককে বাংলাদেশের ভালোবাসতেই হবে!

যাত্রাপালা থেকে রূপালি পর্দায় প্রথম লোককাহিনিনির্ভর বাংলা সিনেমার রেকর্ড গড়া পথচলা

৬০ বছরে ‘রূপবান’ যাত্রাপালা থেকে রূপালি পর্দায় প্রথম লোককাহিনিনির্ভর বাংলা সিনেমার রেকর্ড গড়া পথচলা