বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ ফজলুল হক মণি এক বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব—ছাত্রনেতা, সংগঠক, গেরিলা যুদ্ধের কৌশলী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক এবং যুবরাজনীতির স্থপতি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে হয়েও তিনি নিজস্ব শক্তি, মেধা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে ওঠেন।
পরিবার ও শৈশব
১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী গৃহে জন্মগ্রহণ করেন শেখ ফজলুল হক মণি। তাঁর বাবা নূরুল হক তৎকালীন উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং মা আছিয়া বেগম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। মামা বঙ্গবন্ধুর আদর-স্নেহ ও রাজনৈতিক প্রভাবেই মণির শৈশব-কৈশোর গড়ে ওঠে। তাঁর স্ত্রী আরজু মণি সেরনিয়াবাত এবং দুই সন্তান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস আজও জাতির কাছে তাঁর উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন।
শিক্ষাজীবন
নবকুমার ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ কলেজ, বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ এবং শেষ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এমএ—মণির শিক্ষাজীবন ছিল কঠোর অধ্যবসায় ও অনন্য প্রতিভার পরিচয়। কারাবন্দি অবস্থায়ও ১৯৬৭ সালে তিনি এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।
৬২’র শিক্ষা আন্দোলন: ছাত্রসমাজের কাণ্ডারি মণি
১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন, দেশব্যাপী ধর্মঘট, ১৭ সেপ্টেম্বরের ঐতিহাসিক হরতাল—সব ক্ষেত্রেই মণি ছিলেন সম্মুখসারির নেতা।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৭ সেপ্টেম্বর আজ জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ছাত্রলীগের মনোগ্রাম ও পতাকার রূপকার
স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে ছাত্রলীগের মনোগ্রাম তৈরিতে মণির সংগঠকসুলভ দূরদৃষ্টি এক নতুন পরিচয় দেয় দলটিকে। চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন ও গবেষক মনসুর উদ্দিনকে পরামর্শ দিয়ে তিনি নৌকা, পাটপাতা ও তিন তারকার সমন্বয়ে আজকের ঐতিহাসিক মনোগ্রামটির ভিত্তি রচনা করেন। একইভাবে সাদা-লাল অগ্নিশিখার ওপর নির্মিত ছাত্রলীগের পতাকাটিও তাঁর চিন্তায় প্রণীত।
৬ দফা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক
বঙ্গবন্ধু জেলে এবং ন্যাপসহ কয়েকটি সংগঠনের বিরোধিতার মাঝেও ১৯৬৬ সালের ছয় দফাকে সফল করতে মণি অবিচল ভূমিকা রাখেন। রাতের অন্ধকারে ধানমণ্ডিতে গোপনে যান সংবাদ দিতে, ঢাকার ১১টি অঞ্চলে দলীয় দায়িত্ব বণ্টন করেন, শ্রমিক-ছাত্রদের সংগঠিত করেন। আন্দোলনের দায়ে দীর্ঘ দুই বছর আট মাস কারাবন্দি থাকলেও তাঁকে দমিয়ে রাখা যায়নি।
‘কারাগারের রোজনামচা’-য় মণির উপস্থিতি
বঙ্গবন্ধু তাঁর ডায়েরিতে বারবার উল্লেখ করেছেন কীভাবে একই কারাগারে থেকেও ভাগ্নে মণির সঙ্গে দেখা করতে পারতেন না। ১৯৬৭ সালে জন্মদিন উপলক্ষে পাঠানো কেক ও উপহার ভাগ করে মণিকে পাঠানোর কথাও তুলে ধরেছেন তিনি যা দুই নেতার ব্যক্তিগত সম্পর্কের গভীরতা প্রমাণ করে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনী কর্মসূচির প্রণেতা
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মসূচিকে যুগোপযোগী করতে মণি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বায়ত্তশাসন, জাতীয়করণ, শ্রমিকের শেয়ার মালিকানা, কৃষিজমির খাজনা মওকুফসহ বহু প্রগতিশীল প্রস্তাব তাঁর হাত ধরেই অন্তর্ভুক্ত হয়।
মুজিববাহিনীর প্রধান সংগঠক
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মণির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মুজিববাহিনী গঠন ও পরিচালনায়। চার সেক্টরে বিভক্ত প্রায় পাঁচ হাজার যোদ্ধাকে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল উবানের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ বহু রণাঙ্গনে তিনি নিজ হাতে অভিযান পরিচালনা করেন।
জেনারেল উবানের স্মৃতিচারণে দেখা যায় মণির মানবিকতা, আত্মত্যাগ ও যুদ্ধকৌশল তাঁকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল।

যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা
স্বাধীনতার পর পুনর্গঠনপর্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর মণির হাতেই গঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। অল্প সময়েই সংগঠনটি আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি হয়ে ওঠে এবং যুবসমাজকে রাষ্ট্রগঠনের মূল স্রোতে যুক্ত করে।
সাংবাদিকতা ও সাহিত্য
দৈনিক ইত্তেফাকে শুরু করে ‘গীতারায়’, ‘অবাঞ্ছিতা’, ‘দূরবীনে দূরদর্শী’—মণির লেখনী একইসঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাহিত্যিক গুণে ভরপুর। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক বাংলার বাণী, বাংলাদেশ টাইমস, সাপ্তাহিক সিনেমা—সময়ের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ধারা নির্মাণে বড় ভূমিকা রাখে।
বিশ্ববাসীর সামনে পাকিস্তানি বর্বরতার নথি তুলে ধরতেও তাঁর লেখা ছিল অত্যন্ত প্রভাবশালী।
বাকশাল পর্বের গুরুত্বপূর্ণ নেতা
১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সেক্রেটারি ছিলেন তিনি। ১৪ আগস্ট ১৯৭৫-এ ৬৪ জেলার সম্পাদকদের উদ্দেশে তাঁর শেষ বক্তৃতা কমরেড ফরহাদের ভাষায়,“আমার জীবনে এমন চমৎকার বক্তৃতা আর শুনিনি।”
১৫ আগস্ট: এক নির্মম পরিসমাপ্তি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে ঘাতকের দল প্রথম হামলা চালায় শেখ মণির বাসায়। সেদিন তিনি এবং তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি নির্মমভাবে নিহত হন। একই দিনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করা হয়, রচিত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়।
শেখ ফজলুল হক মণি শুধু বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ছিলেন না। বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, যুবআন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন এক অভিনব শক্তি। তাঁর সংগঠকসত্তা, রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, মানবিকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি অটল অঙ্গীকার আজও নবপ্রজন্মের কাছে অনুকরণীয়।
আজ ৪ ডিসেম্বর ২০২৫, বৃহস্পতিবার, পালিত হবে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, যুবরাজনীতির পথিকৃত এবং সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি–র ৮৭তম জন্মবার্ষিকী। বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ ও সংগ্রামী নেতা হিসেবে শেখ মণির জীবন ও কীর্তি স্মরণ করছে দেশ। পাশাপাশি, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সারাদেশে ও প্রবাসে নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – “বিপ্লবের পর প্রতি বিপ্লব আসবেই” শিরোনামে ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হবে। এতে অংশগ্রহণ করবেন কেন্দ্রীয় যুবলীগ, দেশ-বিদেশের গবেষক, সংগঠনকর্মী ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।
উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করবেন জনাব শেখ ফজলে শামস পরশ চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, এমপি এবং সঞ্চালনা করবেন জনাব আলহাজ্ব মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল, এমপি।