জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) এবং হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর)। কিন্তু ৩২ ঘণ্টা পার হলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। এতে ক্যাম্পাসজুড়ে উত্তেজনা, ক্ষোভ এবং বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।
ধীর গতির গণনা ও অব্যবস্থাপনা
নির্বাচন কমিশন শুরুতে ওএমআর মেশিনে ভোট গণনার পরিকল্পনা করলেও ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠনের অভিযোগের মুখে হাতে গোনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু কমিশনের হাতে পর্যাপ্ত জনবল, টেবিল বা প্রস্তুতি ছিল না। ফলে প্রতিটি হলে ভোট গণনায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। ২১টি হলের ভোট শেষ করতে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এরপর শুরু হয় কেন্দ্রীয় সংসদের প্রায় ২৪ হাজার ব্যালট গোনার কাজ।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন, নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণেই এই দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রক্রিয়াটি জটিল করা হয়েছে, যাতে একটি বিশেষ পক্ষ সুবিধা পায়।
মৃত্যুর ঘটনা ও পদত্যাগ
শুক্রবার সকালে সিনেট ভবনে ভোট গণনার সময় চারুকলা বিভাগের শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস মারা যান। তার সহকর্মীরা অভিযোগ করেন, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা ও অমানবিক চাপই তার মৃত্যুর জন্য দায়ী। এই ঘটনায় শিক্ষক সমাজে গভীর ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
এর মধ্যেই শুক্রবার রাতে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তার পদত্যাগ করেন। তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। এর আগে আরও তিনজন শিক্ষক নির্বাচনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
বর্জন ও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
নির্বাচন চলাকালে পাঁচটি প্যানেল এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জন করেন। তাদের অভিযোগ, ব্যালট পেপারে কারচুপি, বহিরাগতদের হস্তক্ষেপ, আচরণবিধি ভঙ্গ, এমনকি জামায়াত সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ওএমআর মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে। অপরদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির এসব বর্জনকে ‘লেজ গুটিয়ে পালানো প্রতারণা’ বলে দাবি করে।
অপরদিকে বিএনপিপন্থি শিক্ষকরা নির্বাচন বাতিলের দাবি তুলেছেন। ছাত্রশিবির ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে দ্রুত ফলাফল ঘোষণার দাবি জানায় এবং বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের ‘লন্ডনের প্রেসক্রিপশন মেনে নির্বাচন বর্জন’ করার অভিযোগ তোলে।
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও হতাশা
প্রার্থীরা এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট গণনায় বিলম্বে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ডাকসুর মতো বড় নির্বাচন যেখানে একদিনে সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে ৩৩ বছর পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে এমন বিশৃঙ্খলা দুঃখজনক। অনেকেই মনে করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথাযথ প্রস্তুতির অভাব ও সমন্বয়হীনতা এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
কমিশনের অবস্থান
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান গণনার ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, জনবল বাড়ানো হয়েছে এবং চেষ্টা চলছে দ্রুত শেষ করার। তবে নির্দিষ্ট সময় জানাতে না পারলেও তিনি রাতের মধ্যেই ফল ঘোষণা করার আশা প্রকাশ করেছেন।
১১ হাজার ৭৪৩ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী জটিলতায় ছাত্র-শিক্ষক সমাজে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এখন প্রশ্ন একটাই—অভিযোগ ও বিশৃঙ্খলার মধ্যেও জাকসু নির্বাচনের ফলাফল কবে এবং কীভাবে প্রকাশিত হবে।