বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারত থেকে নির্বাসিত অবস্থায় দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ও রয়টার্সকে দেওয়া দুইটি পৃথক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জুলাই আন্দোলনের সময় মানুষ নিহতের ঘটনার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেও এর জন্য তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়ী নন এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভুয়া ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তাকে রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিহ্ন করতে চায় এবং বিচারের নামে একটি প্রহসনের মঞ্চায়ন হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে কোটাপদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া কথিত ছাত্র আন্দোলন পরিণত হয় সারাদেশব্যাপী বড় রাজনৈতিক বিক্ষোভে। আন্দোলনকারীদের দাবী, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে ১,৪০০ জন পর্যন্ত নিহত হয়; যদিও সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ৮৪৩ জনের তালিকাই নিশ্চিত করা হয়েছে যেখানে অন্তত ৫২ জন আন্দোলনভিন্ন কারণে মারা গেলেও নাম অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনায় তখন গভীর উদ্বেগ জানায়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে নির্বাসনে যান। পরে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
শেখ হাসিনার অভিযোগ: “নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে”
দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতা থেকে সরানোর পর তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে যে মামলা চলছে, তা “প্রহসনের বিচার”— রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁর ভাষায়, “অসাংবিধানিক ও অনির্বাচিত সরকারের হাতে বিচারাধীন কেউই ন্যায়বিচার পাবে না।”

তিনি স্বীকার করেন, নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে “শৃঙ্খলাভঙ্গ” বা “ভুল সিদ্ধান্ত” হতে পারে, কিন্তু সরকার কখনোই বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেয়নি। “আমি প্রতিটি নিহত মানুষের জন্য শোক প্রকাশ করি। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে, তার দায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের। এগুলোকে বিকৃত করে আমাকে টার্গেট করা হয়েছে”, বলেন তিনি।
এছাড়া তিনি বলেন, প্রথম হত্যাকাণ্ডগুলোর পর তার সরকার স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা বন্ধ করে দেয়।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর ‘গণহারে ভোট বর্জনের’ হুঁশিয়ারি
রয়টার্সকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, আগামী ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ না দিলে কোটি কোটি ভোটার ভোট বর্জন করবে। “১২ কোটির বেশি নিবন্ধিত ভোটারের দেশে একটি প্রধান দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে তা বৈধতা পাবে না” রয়টার্সকে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় তিনি ভারতেই থাকবেন এবং কোনো নতুন সরকারের অধীনে দেশে ফিরবেন না, যদি সেই সরকার “অবৈধ হয় বা সংবিধান লঙ্ঘন করে”।
তিনি বলেন, “আমরা কারও বিকল্প হিসেবে অন্য দলকে ভোট দিতে বলছি না। আমরা শুধু বলতে চাই, মানুষকে ভোট দিতে উৎসাহী করতে হলে আওয়ামী লীগকেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দিতে হবে।”
অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দাবী করা হচ্ছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) তাকে “মাস্টারমাইন্ড” ও “প্রধান নীতিনির্ধারক” হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। সরকার বলছে, “আইন তার কাজ করছে; কোনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়।”

ড. মুহাম্মদ ইউনূস দাবী করেছেন, ২০২৬ সালের নির্বাচন হবে মুক্ত, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ। তবে তিনি ইঙ্গিত দেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের অংশ নিতে দেওয়া হবে না। আইনি বাধা না কাটলে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ারও কোনো নিশ্চয়তা নেই এমনটাই ইঙ্গিত করেন তিনি।
মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া
আমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ২০২৪ সালের দমন-পীড়নে “নির্যাতন, গুলিবর্ষণ ও জীবনহানির মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে।” জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর এমন হামলা অগ্রহণযোগ্য।”
এদিকে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে না হয়, তা রাজনৈতিক বৈষম্যের দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হবে।
রাজনীতি কোথায় গড়াবে?
শেখ হাসিনা অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন, তিনি দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে চান। “বাংলাদেশকে আবার সাংবিধানিক শাসনে ফিরতে হবে। মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া তা সম্ভব নয়”, বলেন তিনি।
তবে তিনি এটিও বলেন, ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ তার পরিবারকে নেতৃত্বে রাখতে বাধ্য নয়। দল টিকে থাকবে, ব্যক্তি দিয়ে নয় বরং “দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে”।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা আপাত শান্ত মনে হলেও বিশ্লেষকদের মতে, এটি ঝড়ের পূর্বাভাস, নির্বাচন ঘনালে উত্তাপ বাড়বে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন থেকে ছিটকে গেলে রাজনৈতিক বৈধতা, ভোটের অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতার পরবর্তী কাঠামো নিয়ে বড় সংকট তৈরি হতে পারে।