বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, তাঁর দলকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন আয়োজন করা হলে দেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়বে, এবং নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপি–কে দেওয়া লিখিত প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব মন্তব্য করেন।
আগস্ট ২০২৪–এ ছাত্র-জনতার দীর্ঘ বিক্ষোভ, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। হেলিকপ্টারে দেশ ত্যাগের পর থেকেই তিনি নির্বাসনে রয়েছেন। ড. ইউনূসের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার সমর্থক ও দলীয় নেতা-কর্মীদের দমন, গ্রেপ্তার ও মামলার মাধ্যমে রাজনৈতিক মেরুকরণ আরও বাড়িয়ে তুলছে।
“ভবিষ্যৎ সংকটের বীজ বপন”
শেখ হাসিনা বলেন,
“নির্বাচন হচ্ছে মতাদর্শের প্রতিযোগিতা। এখানে জনগণের সামনে বিকল্প থাকা দরকার। আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন মানে জনগণের সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া। এটি ভবিষ্যৎ সংকটের বীজ বপন করবে।”
তিনি আরও বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু তারা রাজনৈতিক প্রতিশোধের পথ বেছে নিয়েছে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে নির্বাচন আয়োজন করলে নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই।”
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনী ব্যবহার করে অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনে করছে, কোনো দলের ওপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে, এবং এটি স্বাধীন নির্বাচনের নীতি লঙ্ঘন করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলা: “আইনগত প্রহসন”
আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে প্রাণহানির অপ্রমাণিত অভিযোগের ভিত্তিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলছে। প্রামাণ্য তথ্যাদি ছাড়াই জাতিসংঘ দাবী করেছে, দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে। সরকার পক্ষের দাবি, শেখ হাসিনা সরাসরি “মারণাস্ত্র” ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন।
কিন্তু শেখ হাসিনা এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, “এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও আইনগত প্রহসন। আমার অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালনার সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে যে রায় আগেই ঠিক হয়ে আছে।” তিনি বলেন, হতাহতের ঘটনা প্রশাসনিক ব্যর্থতা হতে পারে, অতিরিক্ত বল প্রয়োগও ঘটতে পারে, “কিন্তু সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল প্রাণহানি কমানো এবং দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া থেকে রক্ষা করা।”
তিনি দাবি করেন, বিচারক এবং তদন্তকারীরা বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী; তাই নিরপেক্ষ বিচার সম্ভব নয়। “যদি আইসিসি বা আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হয়, আমি সেটি মানতে রাজি। কিন্তু অনির্বাচিত একটি প্রশাসনের পরিচালিত বিচার ন্যায়বিচারকে অপমান করে।”
ভারতে অবস্থান ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের অজ্ঞাতস্থানে ‘অতিথি’ হিসেবে অবস্থান করছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে। তিনি বলেন, “আমি নীরব ছিলাম, কারণ দেশের ভিতরে পরিস্থিতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। কিন্তু সরকার রাজনৈতিক প্রতিশোধের পথ বেছে নেওয়ায় অস্থিতিশীলতা আরও বাড়ছে।”
রাজনীতিতে ফেরার প্রশ্নে সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি জানান, “দেশের কল্যাণই আমার লক্ষ্য। বাংলাদেশের জনগণই আমার শক্তি। সময়ই বলে দেবে আমি কী করব।”
“অপারেশন ডেভিল হান্ট”: গ্রেপ্তার, নিখোঁজ, প্রতিশোধের অভিযোগ
শেখ হাসিনা অভিযোগ করে জানান, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তাঁর সমর্থকদের বিরুদ্ধে “অপারেশন ডেভিল হান্ট” নামে অভিযান চলছে। হাজার হাজার নেতা–কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকেই নিখোঁজ। নিখোঁজদের পরিবার যথাযথ তদন্ত না হওয়ার অভিযোগও তুলেছে।
আওয়ামী লীগ সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠিয়েছে, যেখানে প্রতিশোধমূলক হত্যা, হেনস্তা, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত সহিংসতার তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। হাসিনার প্রশ্ন তুলেন, “যে সরকার মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে, তারা কি এসব ঘটনাও তদন্ত করবে, নাকি শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেই টার্গেট করবে?”
নির্বাচন প্রশ্নে সতর্কবার্তা
তিনি মনে করেন, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হলে সব দলের অংশগ্রহণ জরুরি। “জনগণকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। দল নিষিদ্ধ করে নির্বাচন মানে বিভাজনকে স্থায়ী করা।”
প্রায় ১৫ মাস সকল মাধ্যম থেকে আড়ালে থাকার পর একযোগে শীর্ষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার প্রদানকে বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক নির্ধারক ঘটনা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, এএফপিতে দেওয়া এই প্রতিক্রিয়া তাঁর সমর্থকদের মনোবল ধরে রাখা এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরার কূটনৈতিক কৌশল। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো জানানো হয়নি।