২১ হাজার ১৩৯ কোটি টাকায় নির্মিত হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবন ‘থার্ড টার্মিনাল’। দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা দেশের বিমান পরিবহন খাতে নতুন যুগের সূচনা করবে বলে আশা করা হলেও, উদ্বোধনের এক বছর পরও কার্যক্রম শুরু হয়নি পূর্ণমাত্রায়। অপারেটর নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘদিনের দরকষাকষি, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্থবির আলোচনা এবং নীতিগত সিদ্ধান্তে ধীরগতি সব মিলিয়ে প্রকল্পটি এখন অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে।
অন্যদিকে, দেশের আরেকটি কৌশলগত অবকাঠামো চট্টগ্রাম বন্দরও বিদেশী অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়ার তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। ডিসেম্বরের মধ্যেই নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও আরও দুটি টার্মিনাল বিদেশী কোম্পানির হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে চায় সরকার।
এই দুটি ক্ষেত্রেই, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর, দেশীয় দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা উন্নয়নের বদলে বিদেশীদের ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর সরকারি প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
থার্ড টার্মিনাল: জাপানি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে আলোচনা অনিশ্চিত
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) প্রায় দুই বছর ধরে জাপানের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে থার্ড টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগ নিয়ে দরকষাকষি করছে। কিন্তু এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে টার্মিনালটির ‘সফট ওপেনিং’ করা হলেও যাত্রী ও কার্গো সেবা পুরোপুরি শুরু হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন নীতিগত সিদ্ধান্তে বলা হয়, থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দুই বছরের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাবে। সরকার দাবি করে, এতে বিমান কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করবে। তবে এই সিদ্ধান্ত জাপানি কনসোর্টিয়ামকে ক্ষুব্ধ করেছে বলে জানিয়েছে বেবিচকের একাধিক সূত্র।
বর্তমানে কনসোর্টিয়ামটি চূড়ান্ত চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ভাবছে। তাদের যুক্তি, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার আসলে তারা রাজস্ব ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। ফলে এখনই চুক্তি করার ঝুঁকি নিচ্ছে না তারা।
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক সম্প্রতি জানিয়েছেন, ‘থার্ড টার্মিনালের চুক্তি মূলত রাজস্ব ভাগাভাগির অংশেই আটকে আছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের ‘যুক্তি’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমাদের বিমানবন্দরের সক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি যাত্রী সামলাতে হয়। দ্রুত থার্ড টার্মিনাল চালু করাই জরুরি। তবে এটি সরকারি পর্যায়ের ‘জিটুজি’ (government-to-government) আলোচনা হওয়ায় হঠাৎ বন্ধ করা সম্ভব নয়।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতার ঘাটতি ও নীতি নির্ধারণে বিলম্ব স্পষ্ট হচ্ছে। তারা মনে করেন, প্রশাসনিক ধীরগতি ও চুক্তির অনিশ্চয়তা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
দুর্বল ব্যবস্থাপনা, নষ্ট ভাবমূর্তি
বছরের পর বছর ধরে ঢাকার বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি, লাগেজ চুরি, দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা ও সময়ক্ষেপণের অভিযোগ থাকায় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের বিমান পরিবহন খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সম্প্রতি কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও এ খাতের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার বিষয়টি উন্মোচিত করেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বিদেশী ঋণে তৈরি থার্ড টার্মিনালের বিশাল ব্যয় পুনরুদ্ধারের জন্য দ্রুত কার্যক্রম শুরু করা জরুরি। না হলে ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়বে।”
চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের তোড়জোড়
অন্তর্বর্তী সরকার এখন চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনাল, এই তিনটি বিদেশী অপারেটরের হাতে দিতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যেই চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্য রয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, লালদিয়া টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য এবং বাকি দুটি ২৫ বছরের জন্য বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটি দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় সার্বভৌমত্ব হ্রাস ও কর্মসংস্থান সংকটের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
দেশীয় বিনিয়োগে গড়া টার্মিনাল কেন বিদেশীদের হাতে?
এনসিটি টার্মিনালে জেটি ও আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনাসহ প্রায় ২,৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগামী ২০ বছরে নতুন বিনিয়োগের প্রয়োজন নেই। অথচ এই সফল টার্মিনালটি বিদেশীদের হাতে দেয়ার উদ্যোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শ্রমিক সংগঠন ও ব্যবসায়ীরা।
সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, “সরকারি অর্থায়নে সাজানো এনসিটি টার্মিনালে বিদেশীদের আনার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বে-টার্মিনালের মতো নতুন প্রকল্পে তারা অংশ নিতে পারে, কিন্তু সফল টার্মিনাল বিদেশীদের দিলে রাষ্ট্রীয় আয় কমবে।”
দক্ষতা নয়, নীতিগত সংকট
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্দর পরিচালনার দক্ষতা শুধু অপারেটর নির্ভর নয়। কাস্টমস প্রক্রিয়া, সড়ক অবকাঠামো, জেটির সংখ্যা ও নদীপথের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে বন্দরে সময়ক্ষেপণ হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের মাধ্যমে পণ্য খালাসে বর্তমানে সময় লাগে গড়ে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে অনেক বেশি।
শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, “আমাদের প্রায় দেড়শ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। বন্দরের টার্নঅ্যারাউন্ড সময় অনেক বেশি। কাস্টমস ও পোর্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয় না থাকলে বিদেশী অপারেটর এনে লাভ হবে না।”
বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা ও প্রস্তাব
পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আহ্বায়ক আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বিদেশী অপারেটরদের সুবিধা দিতে বন্দরের মাশুল এক লাফে বাড়ানো হয়েছে। এতে রপ্তানি খরচও বাড়বে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে।”
অন্যদিকে বিমান খাতের বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “বিশ্বে কোথাও নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই টার্মিনাল পরিচালনা করে না। আমাদের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এখনো সেই পুরোনো প্রথায় চলছে, যা ব্যবস্থাপনার অকার্যকারিতা বাড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর বা থার্ড টার্মিনাল, দুটো ক্ষেত্রেই দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ দিতে হবে। বিদেশী অপারেটরের ওপর অতিনির্ভরতা ভবিষ্যতে নীতি-নির্ভরতা তৈরি করবে।”
বিমানবন্দর ও বন্দর, দুটিই দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ধীরগতি ও সিদ্ধান্তহীনতা থার্ড টার্মিনালের কার্যক্রমে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, অন্যদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের মতো লাভজনক খাত বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত হবে স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা, যাতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার নীতি নির্ধারণ করতে পারে।”