সর্বশেষ

উন্নয়ন না সার্বভৌমত্বের ছাড়?

ডিসেম্বরের মধ্যে ৩ টার্মিনালের দায়িত্বে বিদেশি অপারেটর: নৌসচিব

প্রকাশিত: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২২
ডিসেম্বরের মধ্যে ৩ টার্মিনালের দায়িত্বে বিদেশি অপারেটর: নৌসচিব
নৌসচিব মোহাম্মদ ইউসুফ

দেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), লালদিয়ার চর টার্মিনাল এবং ঢাকার পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই বিদেশি অপারেটরের হাতে হস্তান্তর হতে যাচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ জানিয়েছেন, চুক্তি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে।

 

রোববার (১২ অক্টোবর) ঢাকায় ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) এক সেমিনারে সচিব বলেন, “দেশের স্বার্থ রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সর্বোচ্চ পর্যায়ের দরকষাকষি চলছে।” তিনি জানান, লালদিয়ার চর টার্মিনাল ৩০ বছরের জন্য, আর বাকি দুটি ২৫ বছরের জন্য বিদেশি অপারেটরদের কাছে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হবে।

 

যদিও সরকার বলছে, এই পদক্ষেপ বন্দরের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়াবে, বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের মতে, এটি দেশের কৌশলগত অবকাঠামোতে বিদেশি নিয়ন্ত্রণের সূচনা হতে পারে—যার পরিণতি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক নির্ভরতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে প্রভাব ফেলতে পারে।

 

‘দ্রুততা’ নাকি ‘নিয়ন্ত্রণের হস্তান্তর’?

 

সচিব দাবি করেন, বিদেশি অপারেটর এলে বন্দরের জাহাজ খালাসের সময় অর্ধেকে নেমে আসবে, খরচও কমবে। কিন্তু সমালোচকদের মতে, যেভাবে ‘দ্রুততা’ ও ‘দক্ষতা’র নামে বিদেশি কোম্পানিকে এমন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় স্থাপনায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে রাজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও কৌশলগত তথ্যের ওপর বিদেশি প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

নৌসচিব যুক্তি দেন, “শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বহু দেশে বিদেশি অপারেটর কাজ করছে; সেখানে সমস্যা না হলে, এখানে কেন হবে?” তবে এ বক্তব্য অনেকের মনে প্রশ্ন জাগায়, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর কি সেই ব্যতিক্রম নয়, যেখানে বিদেশি বিনিয়োগ শেষে দেশটি ঋণের ফাঁদে পড়ে ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে বন্দরটির নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে বাধ্য হয়েছিল?

 

অর্থনৈতিক যুক্তি, কিন্তু কে পাবে মুনাফা?

 

সরকারের যুক্তি, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে; কিন্তু অর্থনীতিবিদদের অনেকে বলছেন, এতে লাভের বড় অংশ বিদেশে চলে যাবে, স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রভাব পড়বে, আর জাতীয় রাজস্বের হিসাব স্বচ্ছ থাকবে না।

 

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ছয়টি স্ক্যানার থাকলেও বেশিরভাগ সময় ৩–৪টি সচল থাকে না। সচিবের মতে, “বিদেশি প্রতিষ্ঠান এলে স্ক্যানিং হবে আধুনিক উপায়ে।” কিন্তু এর মানে কি, জাতীয় নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট পণ্য বা তথ্যও বিদেশি অপারেটরের হাতে যাবে? এই প্রশ্নও উঠছে বিশেষজ্ঞ মহলে।

 

সেমিনারে কথা বলেন ব্যবসায়ী নেতা আজম জে চৌধুরী

 

সেবা ফি বাড়বে, খরচ কমবে নাকি উল্টোটা?

 

বিদেশি অপারেটর আসলে সেবা ফি বাড়তে পারে এ আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের। সচিব বলেন, “১৯৮০ সাল থেকে একই ফি চলছে। যৌক্তিকভাবে কিছুটা বাড়ানো হতে পারে।” কিন্তু অনেকে আশঙ্কা করছেন, “যৌক্তিক” বৃদ্ধির আড়ালে বিদেশি কোম্পানির মুনাফার হারই বেশি প্রাধান্য পাবে, ফলে পণ্য খালাসের খরচ কমার বদলে আরও বেড়ে যেতে পারে।

 

এছাড়াও সমুদ্রগামী জাহাজ চলাচলে ২০৩০ সালের পর থেকে জ্বালানি ব্যবহারে নতুন নির্দেশনা আসছে। বর্তমানে ব্যবহৃত তেলের বদলে অ্যামোনিয়া বা বায়ো-ফুয়েল ব্যবহার করতে হবে। এর ব্যতয় হলে আয়ের অন্তত ৩০ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে জাহাজ মালিকদের।

 

সেই তথ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির সভাপতি আজম জে চৌধুরী বলেন, “একসময়ে মাত্র ৩৬টি সমুদ্রগামী জাহাজ ছিল বাংলাদেশের। এখন সরকারের সহযোগিতায় সুবিধা পাওয়ায় তা ১০২টিতে উন্নীত হয়েছে।

 

“২০৩০ সাল পর্যন্ত জাহাজ ক্রয় ও পরিচালনায় শুল্ক অব্যাহতি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে তা বাতিল করেছে। সুবিধা অব্যাহত রাখা দরকার।”

 

সাগরপথে সরকারি পণ্য আনতে সরকারি জাহাজ ব্যবহারের শর্ত তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এ ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “এখাতে বিনিয়োগে সরকার সহযোগিতা করলে বাংলাদেশি মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা বাড়বে। মেরিন একাডেমি পড়ুয়া ছাত্রদের কর্মসংস্থান বাড়বে। তারা প্রতি বছরে দেশে বর্তমানে এক দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স হিসেবে আনছে।”

 

উল্লেখ্য, তিনটি টার্মিনালই শেখ হাসিনা সরকারের সময় নির্মিত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (২০০৮), লালদিয়ার চর টার্মিনাল ও পানগাঁও কনটেইনার টার্মিনাল (২০১০)। সেই সময় এগুলোকে জাতীয় সম্পদের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। এখন সেগুলো বিদেশি হাতে গেলে, অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন জাতীয় সম্পদ কি তবে বেসরকারি ও বিদেশি স্বার্থের হাতে চলে যাচ্ছে?

 

বিদেশি অপারেটরের অংশগ্রহণের ফলে প্রযুক্তি ও দক্ষতা বাড়লেও, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে তাদের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অনেকেই মনে করছেন, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনাকে “উন্নয়ন” নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের পথে নিয়ে যাচ্ছে যা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে।

 

এখন প্রশ্ন একটাই, এটি কি দক্ষতার উন্নয়ন, নাকি সার্বভৌমত্বের অবক্ষয়?

সব খবর

আরও পড়ুন

প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ বাতিলে উদীচীর তীব্র প্রতিবাদ

প্রাথমিকে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষাবিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ বাতিলে উদীচীর তীব্র প্রতিবাদ

কে চালাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি?

জাকার্তা পোস্টের বিশেষ প্রতিবেদন কে চালাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি?

শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নতুন বাস্তবতা

শ্রীলংকা গার্ডিয়ানের বিশেষ বিশ্লেষণ শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নতুন বাস্তবতা

২০৮ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র তিনটি: জনপ্রশাসন সংস্কার আটকে কোথায়?

সংস্কারের হাল-হকিকত ২০৮ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র তিনটি: জনপ্রশাসন সংস্কার আটকে কোথায়?

আজ জেলহত্যা দিবস

৩রা নভেম্বর আজ জেলহত্যা দিবস

বিশ্ববাজারে গমের দরপতন, দেশে উল্টো বাড়ছে আটার দাম

অতিরিক্ত দামে বিপাকে স্বল্প আয়ের মানুষ বিশ্ববাজারে গমের দরপতন, দেশে উল্টো বাড়ছে আটার দাম

স্বাস্থ্য খাতে ৩৩ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র ৬টি

সংস্কারের হাল-হকিকত স্বাস্থ্য খাতে ৩৩ সুপারিশের মধ্যে বাস্তবায়ন মাত্র ৬টি

ডিসেম্বরে বাংলাদেশে খাদ্যসংকটে পড়বে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ, ঝুঁকিতে ১৬ লাখ শিশু

আইপিসি রিপোর্ট ডিসেম্বরে বাংলাদেশে খাদ্যসংকটে পড়বে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ, ঝুঁকিতে ১৬ লাখ শিশু