সর্বশেষ

লালনের সুরে অনন্ত যাত্রা

প্রকাশিত: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:১৬
লালনের সুরে অনন্ত যাত্রা

বাংলার গান, বাংলার মাটি আর বাংলার মানুষ—এই তিনের এক অনন্য সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছিলেন ফরিদা পারভীন। গতকাল তিনি চলে গেলেন। চলে গেলেন মানে কেবল একজন শিল্পীর বিদায় নয়, বরং এক দীর্ঘ সাধনার অবসান, এক অমূল্য সম্পদের অন্তিম নীরবতা। তবু তিনি যে সুরের উত্তরাধিকার রেখে গেলেন, তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বেঁচে থাকবে, যেমন বেঁচে থাকে নদীর গান কিংবা আকাশের বাতাস।


ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান ছিল অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। মনে হতো, সুর যেন তাঁর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, তিনি কেবল বাহন। ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘আমার গরবিনী মা’, কিংবা ‘মনরে ক্রোধী হলে’—এসব গান তাঁর কণ্ঠে পেত এক অন্য মাত্রা, যেখানে ভক্তি, দর্শন আর মানবতা একাকার হয়ে যেত। শ্রোতারা শুধু গান শুনতেন না, গানকে অনুভব করতেন। তাঁর কণ্ঠে লালন সাঁই হয়ে উঠতেন সমকালীন, হয়ে উঠতেন বিশ্বজনীন।
 

শৈশবে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ নিয়েছিলেন। নজরুলগীতি, আধুনিক গানেও ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি লালনের গানকে বেছে নিলেন, কারণ তাঁর কাছে লালন ছিলেন শুধু একজন কবি বা গীতিকার নন, বরং মানুষকে মানুষ চেনার গুরু। তিনি একবার বলেছিলেন, “লালন সাঁইকে গাইতে গাইতে আমি তাঁকেই খুঁজে পাই, নিজের ভেতরে পাই।” সেই অভিজ্ঞতাই তাঁকে আলাদা করেছে অন্য সবার থেকে।
 

বিশ্বের নানা প্রান্তে তিনি বাংলার গানকে পৌঁছে দিয়েছেন। লন্ডনের মঞ্চে যেমন তিনি লালন গেয়েছেন, তেমনি টোকিও বা প্যারিসেও তাঁর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে বাংলার আধ্যাত্মিক সুর। বিদেশি শ্রোতারাও বিস্ময়ে শুনেছেন—কীভাবে বাংলার গ্রামীণ গান হয়ে উঠতে পারে সার্বজনীন মানবতার বাণী।
 

রাষ্ট্র তাঁকে দিয়েছে একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। তবু প্রশ্ন থেকেই যায়—আমরা কি তাঁকে যথেষ্ট মর্যাদা দিতে পেরেছি? সত্যিই কি আমরা তাঁর সাধনাকে উপলব্ধি করেছি? হয়তো না। তাঁর মতো শিল্পীরা এতটাই মহীরুহ যে কোনো পদকই তাঁদের অবদানকে ধারণ করতে পারে না।
 

তাঁর প্রয়াণের পর দেশজুড়ে শোক নেমে এসেছে। গুণী শিল্পী রুনা লায়লা বলেছেন, “ফরিদা ছিলেন শুধু এক সহশিল্পী নন, তিনি ছিলেন এক প্রেরণা। তাঁর কণ্ঠে লালনের গান শুনে মনে হতো বাংলা গান অমর।” শফি মণ্ডল বলেছেন, “আমরা শুধু একজন শিল্পীকে হারাইনি, আমরা হারিয়েছি লালনের বাণীর এক অগ্রণী সাধককে।”
 

ফরিদা পারভীনের মৃত্যু যেন আমাদের মনে করিয়ে দিলেন ; আমরা কত দ্রুত আমাদের সত্যিকারের রত্নদের হারিয়ে ফেলি। তাঁরা থাকেন না, কিন্তু রেখে যান সুর, রেখে যান প্রেরণা। হয়তো এটাই তাঁদের অমরত্ব। আজকের এই শোকাবহ মুহূর্তে আমরা তাঁকে স্মরণ করি গভীর কৃতজ্ঞতায়। তিনি ছিলেন বাংলার আত্মার প্রতিধ্বনি, লালনের বাণীর দূত, মানবতার কণ্ঠস্বর। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর গান থাকবে—অবিচল, অনন্ত, চিরকালীন।

সব খবর