সর্বশেষ

লীলা আমার মায়ের নাম

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৪৭
লীলা আমার মায়ের নাম

সারোকোনার ফকির বাড়ির ছেলে এলদেম। বন্দিশ ফকিরের অধঃস্থন দ্বিতীয় পুরুষ। অকাল প্রয়াত মজলিশ ফকিরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের একমাত্র সন্তান। প্রথম স্ত্রীর সন্তান সন্ততি হয় নাই, তার অনুমতিক্রমে মজলিশ ফকির দ্বিতীয়বার শাদি করেছিলেন। পুত্র লাভ হয়েছে। সেই পুত্র পড়ালেখা করে স্কুল শিক্ষক হয়ে বাপ দাদাজানের মুখ উজ্জ্বল করে নাই, মুখে ভুষিকালি মাখিয়ে দিয়েছে। ফকিরদের সামাজিক শত্রু সৈয়দদের ঘরের মেয়ে চমন আরাকে শাদী করে পলাতক হয়েছে। সৈয়দদের মুখেও ভুষিকালি পড়েছে। বড় সৈয়দ সালিশে রাজী হন নাই। ঘোষণা দিয়েছিলেন, হাটবারে ছয় কল্লার মাঠে নিজহাতে জবাই করবেন মেয়েকে। এই মর্মে এলদেম ফকিরের বড় মা ওয়াসেকা বিবি বেজায় রুষ্ট হয়েছিলেন, ‘জবাই করবো আমার ফুতের বউরে? দেখি সৈয়দের ব্যাটার ক্ষমতা!’


বড় মা সৈয়দের ব্যাটার ফুফুর ঘরের বোন। দিন শেষে তাই সারোকোনার ছয় কল্লার মাঠে কিছু ঘটে নাই—এলদেম ফকির চমন আরাকে নিয়ে সারোকোনায় ফিরল। ফকিরবাড়ির বউ হলো রূপবতী চমন আরা। ফকিরদের সঙ্গে সৈয়দদের বিবাদ মিটল। কিন্তু কেউ শান্তিতে থাকতে পারে কীভাবে? ১৯৭১ সাল সেটা। ফকির বাড়িতে রেডিও আছে। চমন আরা রেডিও শুনে।—যুদ্ধ হচ্ছে টাউনে, আরও দুরের গ্রামে। রেডিওতে যুদ্ধের গান হয়। এলদেম ফকির চমন আরাকে গোপনে বলল, সারোকোনার দুইজন মানুষ গেছে যুদ্ধে। হালিম মাস্টার আর ধীরু কৈবর্ত। সেও যাবে। চমন আরা বলল, ‘কই যাইবেন?’
এলদেম ফকির বলল, ‘কেন? যুদ্ধে।’
চমন আরা বলল, ‘আপনে যুদ্ধে যাইবেন, মানুষ মারবেন? আপনে কোনওদিন একটা পাখি নি মারছেন!’
‘এইটা যুদ্ধ। পাখি মারা না। যাই। দেশ স্বাধীন করে ফিরব।’
‘আপনে ফিরবেন না। একবার গেলে আর ফিরবেন না।’
‘কসম ফিরব।’
চমন আরা এলদেম ফকিরকে ধরে রাখে নাই।
 

হালিম মাস্টার, ধীরু কৈবর্তর পর সারোকোনার এলদেম ফকির ‘মুক্তি’ হয়েছে।—টাউনে গিয়ে শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছে সারোকোনার পিশাচ বগা সুদখোর, পথ দেখিয়ে হানাদার বাহিনীকে সারোকোনায় নিয়ে এল সে। সারোকোনা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল হানাদার বাহিনী। ধরে নিয়ে গেল চমন আরা, হালিম মাস্টারের বউ জমিলা, কৈবর্তদের বউ-ঝিদের। সেই নির্যাতন নিপীড়নের বিবরণ অকথ্য। ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।
 

দেশ স্বাধীন করে হালিম মাস্টার, ধীরু কৈবর্ত বিধ্বস্ত সারোকোনায় ফিরল। চমন আরা, জমিলারা ফিরল। আরও মানুষ ফিরল। এলদেম ফকির শুধু ফিরল না।
 

অপমান আর চরম গ্লানির সেই সব দিন। চমন আরা মনে করে না আর। মঙ্গলকাটার কবিরাজ কাকা ফিরেছেন, তাকে ডাকিয়ে এনেছিলেন ওয়াসেকা বিবি। চমন আরা তার পেটের সন্তান নষ্ট করতে রাজি হয় নাই। ওয়াসেকা বিবি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তবে ছেলে যখন জন্মালো, স্বর্ণের মোহর দিয়ে সেই ছেলের মুখ দেখেছিলেন। ছেলের নাম রেখে দিয়েছিলেন মউজদীন। এলদেম ফকিরের ছেলে মউজদীন ফকির।
 

সেই মউজদীন ফকিরের বয়স এখন চুয়ান্ন। দ্য নেইম ইজ মউজ দীন—এভাবে বলে সে। নাম থেকে ফকির কেটে দিয়ে বলে। দুই বার ফকির হয়ে কাজ নাই।—বাংলা ‘দীন’ শব্দের অর্থ দরিদ্র অর্থে ‘ফকির’ বটে।
 

মউজ দীন পেইন্টার। সুইডেনে থাকে। দেশে ফিরেছে, সোলো করেছে জয়নুল গ্যালারিতে। ‘দিকে দিকে পড়ে সাড়া’ সব ছবি বিক্রি হয়ে গেছে। এ মাসেই সুইডেনে ফিরে যাবে মউজ দীন। আর আটদিন আছে দেশে।
 

মেয়েটার নাম লীলা। আর্ট ক্রিটিক। পোলাপান এখনও। ওয়াকিল ভাই রেফার করেছেন, একে একটা ইন্টারভিউ দিতে পারো তুমি।
দিতে পারে।
 

সেই লীলা নাম্নী উপস্থিত হয়েছে চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট আগে। সাদর অভ্যর্থনা করেছে মউজ দীন। এক মগ কফি বানিয়ে দিয়েছে এবং চুপ করে বসে থাকতে বলেছে লীলাকে। ছবি আঁকা শেষ করে কথা বলবে তারা। বড় একটা পেইন্টিং ধরেছে মউজ দীন। আট ফুট-ছয় ফুট। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে যাবে। মউজ দীনের কাজের ধরন বাস্তববাদী। নানা বয়সের মানুষের ফিগার, ঘোড়ার ফিগার, মাতৃস্তন্য-মানুষের, কুকুরের, ড্রয়িং করে। কেউ বলে সে পরাবাস্তব কেউ বলে অধিবাস্তব দ্যোতনা তৈরী করে পেইন্টিংয়ে। মউজ দীন নিজে কী মনে করে? এত কিছু মনে করে না। সময় নাই। সে আর্টিস্ট, আর্ট ক্রিটিক না।
 

চমন আরা গত বছর ছিয়াত্তর বছর বয়সে মরেছেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চান নাই, পান নাই। এ নিয়ে কোনপ্রকার শোকতাপ নাই মউজ দীনের ভেতরে। চমন আরার কবর সারোকোনায় হয়েছে। চমন আরার ডাক নাম ছিল লীলা। বন্দিশ ফকির তার নাতিছেলের বউকে ‘লীলা বেটি’ ডাকতেন।
 

আর্ট ক্রিটিক লীলা মেয়েটার বয়স বিশ একুশ হবে। চশমাউলি। বড় বড় চোখ। ভেরিডিয়ান গ্রীন শার্ট পরে আছে, খাকি ট্রাউজারস। চুল পানিটেইল করে বেঁধেছে, বোঁচা নাকের ড্রয়িং শুধু চমন আরার মতো। চমন আরার সঙ্গে আর কোনও মিল নাই। মউজ দীন বিরতি নিল। লীলার সঙ্গে বসল।
লীলা বলল, ‘কফির জন্য ধন্যবাদ, স্যার।’
‘কফি কি ভালো হয়েছে?’
‘চমৎকার হয়েছে।’
‘কফির দোকান দেওয়ার মতো চমৎকার হয়েছে?’
‘জি-স্যার?’
‘আমি কফির দোকান দিতে পারি?’
লীলা হেসে উঠল, ‘শিওর স্যার।’
 

চমন আরা লীলার সঙ্গে আর্ট ক্রিটিক লীলার আরেকটা মিল আবিস্কার করল মউজ দীন। লীলার চিবুকে টোল পড়ে হাসলে। চমন আরা লীলার বাম গালে পড়ত।
লীলা বলল, ‘আপনাকে দেখছিলাম। ছবি আঁকছিলেন, মনে হচ্ছিল না এই পৃথিবীতে আছেন।’
‘এখন মনে হচ্ছে? তুমি লীলা? বাংলা লীলা না ইংলিশ লীলা?’
‘সরি স্যার?’
‘পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লীলা নাম আছে। বাংলা, ইংলিশ, হিন্দি, মেক্সিকান, টার্কিশ, জার্মান।’
‘সুইডিশ ভাষায় নাই?’
‘আছে।’
লীলা সহজ গলায় বলল, ‘আমার নামটা মনে হয় বাংলাই স্যার। চমন আরা রেখেছে তো।’
‘চমন আরা?’
‘সরি, আমার মা স্যার, চমন আরা।’
 

মউজ দীন নিরাবেগ থাকল। শুধু চিন্তা করল এটা কী রকম হলো? এই মেয়েটার নাম লীলা, এর মায়ের নাম চমন আরা। চশমাউলি লীলাকে তার সঙ্গে দুপুরে লাঞ্চ করে যেতে বলল মউজ দীন। তারা কথা বলল মউজ দীনের পেইন্টিং, অ্যানাটমিক্যাল ড্রয়িং, জয়নুল আবেদীনের ‘বাংলা’, এস এম সুলতানের ‘প্রথম বৃক্ষ রোপন’ এবং লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ‘বিট্রুবিয়ান ম্যান’ ইত্যাদি নিয়ে। লীলা পেইন্টিংয়ের বিভিন্ন জনরা ও মুভমেন্ট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। দেশের সমকালীন পেইন্টারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে মোহাম্মদ ইউনুস ও মোহাম্মদ ইকবালকে। দুইজনের কাজ দুই জনরার যদিও।
 

অবশেষে অরিন্দম কহিলা বিষাদে।
 

‘স্যার আপনাকে নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর আলোচনা আছে সামাজিক মাধ্যমে।’
‘আমি কী করতে পারি ইয়াং লেডি? তোমার কী মনে হয়? আমি কে? আমার পেইন্টিং দেখে কী মনে হয়? আমি কি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান? আমি কি যুদ্ধশিশু? আমার বাবাকে আমি দেখি নাই। আমার বাবা কে আমি দেখি নাই। আমার মা চমন আরা লীলা কখনওই আমাকে কিছু বলেন নাই।’
‘সরি, স্যার?’
‘তুমি লীলা। তোমার নাম তোমার মা চমন আরা রেখেছেন। কোইন্সিডেন্স হতে পারে। আমার মায়ের নাম চমন আরা লীলা। আমি যদি আবার তোমার পেট থেকে জন্মাই?’
 

এতো সহজভাবে এমন একটা অতি জটিল কথা বলে ফেলা যায়? লীলার দাদাজান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। বড় দুই চাচা মুক্তিযোদ্ধা। দুই মামা মুক্তিযোদ্ধা। মউজ দীনের সহজ ভাবের কথা লীলার অন্তর্গত শোনিত প্রবাহ ত্বরান্বিত করল। প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে লীলা মনে মনে তার অনাগত সন্তানকে বলল, ‘শিওর, মাই চাইল্ড।’

সব খবর