সর্বশেষ

খেলিছে জলদেবী

প্রকাশিত: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০:৫০
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে আমরা প্রকাশ করছি বিশেষ ধারাবাহিক “রক্তে রাঙা বিজয় আমার”। এতে থাকছে গবেষণাধর্মী নিবন্ধ, মতামত, বিশ্লেষণ, কবিতা, গল্প ও সৃজনশীল রচনা যেখানে উঠে আসবে ১৯৭১-এর ইতিহাস, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম ও বিজয়ের চেতনামূলক আলোচনা। “রক্তে রাঙা বিজয় আমার”-এ আজকের পর্বে থাকছে অদিতি ফাল্গুনীর গল্প ‘খেলিছে জলদেবী’। অদিতি ফাল্গুনীর এই গল্পটি একটি জলদেবীর রূপক যে কখনো ভাগিরথী, কখনো গঙ্গা, কখনো শিল্প, আবার কখনো নারীর দেহ ও স্মৃতি। ১৯৭১ থেকে ২০২৪–যুদ্ধ, ক্ষমতা, সংস্কৃতি ও উগ্রবাদের ধারাবাহিকতায় ভাঙা ভাস্কর্য, লাঞ্ছিত দেহ ও নিশ্চুপ শিল্পীর মধ্য দিয়ে উঠে আসে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক জুলাই–আগস্টের আন্দোলন, শাসন বদল ও তার পরবর্তী সাংস্কৃতিক-সামাজিক অস্থিরতা। জল এখানে ইতিহাস, প্রতিরোধ ও স্মৃতির প্রতীক যাকে দমন করা যায়, কিন্তু মুছে ফেলা যায় না।
খেলিছে জলদেবী

ভাগিরথী এক অত্যাশ্চর্য নদী। অথবা বিধবা রমণী। নি:সন্তান। প্রতিদিনই কাছের গ্রাম থেকে খেয়া পাড় হয়ে পিরোজপুর সদরে এসে মানুষের ঘরে ঘরে ঘর কুড়ানো, মোছা, মাছ-আনাজ কোটা, ঝুল ঝাড়া, ময়লা কাপড় কাচার কাজ করে আবার সন্ধ্যার আগে আগে ফিরে যেত নিজের গ্রামে। তবু, রথীন্দ্র পালের বাবা সুরেন্দ্র পাল যেদিন একটি হোন্ডার পেছনে ভাগিরথীকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গোটা পিরোজপুর শহরে ছেঁচড়ে নিয়ে চলে, শেষে বলেশ্বর নদীর পাড়ে নিয়ে আর একটি গুলি করে, লাথি মেরে ফেলে দেয়ার দৃশ্য দ্যাখে, এরপর থেকে সে আর কখনো কোন দেবী প্রতিমা গড়েনি। জ্যাঠা-কাকারা এ নিয়ে অনেক বললেও সুরেন্দ্র পালের ছিল একটিই অকাট্য যুক্তি: “দুর্গা মা যদি সত্যিই দশপ্রহরণধারীনী হয় আর কালী মা’র হাতেও যদি অমন খড়গ থাকে, তইলে ভাগিরথীর এমন বেইজ্জতি হয়? আমি যে চোখের সামনে দ্যাখলাম...সারা রাস্তা ওরে পাঞ্জাবীরা বাইকের পেছনে অমন ছেঁচড়ায় ছেঁচড়ায়, বাউড়ায় বাউড়ায় নিয়া গেলো, তখনো আইজকের মত এমন নরম রাস্তা না...ইটের খোয়া ভাঙা রাস্তার উপর ওরে ছেঁচড়ায় নিয়া যাচ্ছে- মানুষ না- যেন বধ হওয়া পশু গোঙ্গাচ্ছে- আর ওর শরীরের রক্ত ছিটকায় ছিটকায় পড়তেছে রাস্তার উপর- এই কালী মা কী দুর্গা মা বাস্তবে থাকলে এমন হয়? যে দেবী নাই, তার প্রতিমা বানায় কী হবে?”

 

“তুই কী নাস্তিক হইয়া গেলি, সুরেন্দ্র? পালের ছেলে প্রতিমা না বানাইলে খাবি কী?”

 

না- দুই জ্যাঠার হাজার ধমকেও বাবা গোঁ বদলায়নি। অন্য কাজ করতো অবশ্য কিছু কিছু। প্রতিমা গড়া পালরা ত’ অন্য পালদের মত মাটির হাঁড়ি-কুড়ি বা কলস- এসব বানায় না। তবে বাবা চৈত্র সংক্রান্তি কী বৈশাখের মেলার আগে বা বারুণী মেলা বা যে কোন পালা-পার্বণের আগে বাচ্চাদের জন্য হাতি-ঘোড়া-পুতুল-বউ এসব বানাতো। তবে, তাতে আর ক’পয়সাই বা আয় হয়? একান্নবর্তী পরিবার বলে না সবাই মিলে চলে গেছে একরকম। 

 

বাবার কাছে বা এলাকার অনেকের কাছেই ভাগিরথীর গল্প শুনেছে রথীন্দ্র। বিশেষ করে তাকে মোটর বাইকে ছেঁচড়ে নিয়ে চলা বা বলেশ্বর নদীতে ফেলে দেবার গল্প। বলেশ্বর নদী না নদ? নদীরও ত’ স্ত্রী বা পুরুষ লিঙ্গ থাকে। আর ভাগিরথী...গঙ্গা আর ভাগিরথী কী একই নদীর দু’টো নাম? একই নদীকে আলাদা আলাদা নামে ডাকা হয়? ঠাকুর মা এসব নানা গল্প জানতো। বুড়ি মরে গেছে বেশ কয়েক বছর! তবু মোটর বাইকে ময়লা, সাদা থান পরা আর ছেঁচড়ে নিয়ে চলা যে বিধবা যুবতীর গল্প রথীন্দ্র তার জনপদের অন্য অনেক শিশুর মতই জন্ম থেকে শুনে বড় হয়েছে, তাকে যেন কল্পনায় যতটা না ‘ভাগিরথী’, তারও চেয়ে বেশি ‘মহাভারত’-এর গঙ্গার মত মনে হয়। সেই গঙ্গা যতটা না নদী, তারও চেয়ে বেশি যেন নারী। শাপভ্রষ্টা স্বর্গলোকের নারী যাকে আবার মর্ত্য ছেড়ে অমর্ত্যে ফিরে যেতে হবে। তাই ত’ মহারাজা শান্তনুর পরিণয় প্রস্তাবে দিলেন সেই কঠিন শর্ত। বিয়ের পর তাঁর সব কাজ নি:শর্ত মেনে নিতে হবে। যদিও এলাকার বুড়োরা বলে, “ভালই হইছে মারা গিয়া। বাঁইচা থাকলে- একে বিধবা, ছেলে-মেয়ে ছিল না। মানুষের বাসায় কাজ করতো। তারপর যুদ্ধের সময় কত অত্যাচার সইলো ওর শরীরে। এখন না হয় আমরা শহীদ মিনারের সামনে কালো সাইনবোর্ডে ওর নামটাও দেখি- শহীদ ভাগিরথী সাহা- বাঁইচা থাকলে? হাহ্! নিজ ভাই-বেরাদার ত’ বটেই, কুত্তা-বিড়ালেও পুঁছতো না!”

 

এলাকার বুড়োরা আরো বলে যে যুদ্ধের সেই সময়টায়---তখনো আজকের মত নরম রাস্তা নয়...ইটের খোয়া ভাঙ্গা রাস্তায় ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে নিয়ে চলা ভাগিরথী...যুদ্ধের শুরুতেই আর্মি ক্যাম্পে ওকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল...কিছু দিন টানা ধর্ষণের পর কী মনে হয়েছিল তার...একটু যেন বা খাতিরই গড়ে তুলেছিল সে পাঞ্জাবীদের সাথে...পাঞ্জাবীগুলোও বহু দূরের দেশে বউ-বাচ্চা ফেলে এসে, ক্যাম্পের এই বঙ্গাল মেয়েরা খুব ধ্বস্তাধ্বস্তি না করলে বা শুরুতে ধ্বস্তাধ্বস্তির পর পরে ধীরে ধীরে সব কিছু মেনে নিতে শিখলে...সন্ধ্যায় বোতল খোলার পর এই চুল কেটে ফেলা, নগ্ন করে রাখা মেয়েমানুষগুলোর সামনেই তাদের মন খুলে ধরতো।

 

উর্দূ ত’ কয়েক মাসে শিখেই নিয়েছিল ভাগিরথী। খান সেনাদের মন জয় করার অভিনয় করে করে ঘরের বাইরে টুকটাক বের হবার স্বাধীণতা অর্জন করেছিল সে। এতটাই প্রিয় হয়ে উঠেছিল খান সেনাদের যে সন্ধ্যার পর তাদের গ্লাসে মদ ঢেলে দেবার কাজও সে পেয়েছিল। আর এভাবেই ওদের গোপণ সব কথা জেনে, বাইরে এসে লুকিয়ে সে দেখা করতো পানের বরজের পান বেপারী, ফেরি ঘাটের পাশের ডাবঅলার ডাবের স্তপের সামনে কী বলেশ্বর নদীর ঢেউ বেয়ে বেয়ে সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার করে আনা শিকারীর মাংসের বাজারে ক্রেতার ছদ্মবেশে পাহারা দেওয়া লড়িয়েদের সাথে। ময়লা শাড়ির বিধবা মেয়েটি যে কিনা যুদ্ধের ক’মাসে ‘বিধবা’ থেকে হয়ে উঠেছে ‘খান সেনাদের বউ’, তার কাছ থেকেই যা জানার জেনে বাঙ্গালী ছেলেরা কয়েকবারই কি উড়িয়ে দেয়নি খানদের একাধিক আস্তানা? সে যতই ‘পাঞ্জাবীদের বউ’ হয়ে উঠুক ভাগিরথী?

 

তবে কিনা পাঞ্জাবীরাও যেদিন বুঝে গেলো যে এই ‘বঙ্গাল কা লেড়কি’ অথচ ক্যাম্পে তাদেরই ধরে আনা রাতের বধূদের একজন এই মেয়েটিই গোপনে গোপনে এত বড় সব গাদ্দারি করছে, তারপর ত’ গাদ্দারির মূল্য যা চুকিয়ে দেবার, সেটা পাঞ্জাবীরা চুকিয়ে দেবেই। 

 

“ভাগিরথীর একটি ভাস্কর্য বানাবে নাকি- রথীন্দ্র?” এলাকার এম,পি, বলেছিলেন। “এখনো আমাদের সরকার ক্ষমতায়। নানা জায়গায় নানা কিছু বানাও শুনি। তোমার নাম এখন পেপারে ছাপা হয়।”

“বানাব। কিন্তু হাতে কাজী নজরুল ইসলামের উপর একটা কাজ আছে। ঐটা আগে শেষ করি।”

“নজরুলের উপর কী কাজ? ”

“ত্রিশালে কাজী নজরুল ইসলাম ভার্সিটিতে নজরুল জন্ম-জয়ন্তী উপলক্ষ্যে একটা ভাস্কর্য বানানোর অর্ডার পাইছি।”

“বাহ্- বেশ। তোমাগো ফ্যামিলিতে তুমিই ত’ প্রতিমা বানানোর কাজ ছাইড়া ভাস্কর্য বানানোয় গেলা- তাই না? ”

“জ্বি- চাচা! ”

“তুই কী আর প্রতিমা বানাও এখন? ঢাকায় ত’ শুনছি চারুকলাতেও পড়ছো? ”

 

এমপি সাহেব খাঁটি বরিশালী রীতিতে বয়সে ছোটদের সাথে সমানে ‘তুমি’ ও ‘তুই’ মিশ্রণে কথা চালাতে থাকেন। 

 

“জ্বি- চাচা! চারুকলায় পড়ছি। প্রতিমা এখন আর না বানাইলেও আগে বানাইছি। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ও একটা বড় লক্ষী প্রতিমা গড়ছিলাম। ঠাকুর্দ্দার সাথে দুর্গা প্রতিমায় হাত দিছি।”

“তা’ প্রতিমা বানানো তুই ছাড়লা ক্যান?”

“ঐ ক্লাস নাইন-টেনে উঠতে উঠতে ভাস্কর্যর উপর একটা প্রবন্ধ পড়লাম কোথায় জানি। ভাস্কর্য অনেকদিন টেঁকে। আর এই যে মাটির প্রতিমা আমরা গড়ি- এ ত’ গড়ার পরেই নদীতে ’ভাসান’ দিতে হয়- মানে ’বিসর্জ্জন’ দিতে হয়।”

 

“সে না হয় শিখলা ভাস্কর্য! তোমাগো বাড়িতে তুমি একাই ঢাকা ভার্সিটির আর্ট কলেজে পড়ছো। কম কথা? কিন্তু মানে আমি ভাবি কী আমাগো সুরেন্দ্র কী নিজ বাপ-দাদার ধর্ম-কর্ম ছাইড়া দিল নাকি? তোমার জ্যাঠা সেদিন একটা কাজে আমার কাছে একটা দরখাস্ত নিয়া আইসা দু:খ করতেছিল যে তুমি এখন আর দেবী প্রতিমা বানাইতে হাত দ্যাও না। তোমার বাপ ত’ সেই যুদ্ধের পর আর কোনদিনই প্রতিমা বানায় নাই!”

 

“না- এমপি চাচা- আমাগো প্রতিমা বানানোর রীতির সাথে ভাস্কর্য বানানোর রীতির কিছু পার্থক্য আছে। ভাস্কর্যতে কিনা থ্রি-ডাইমেনশন আর প্রতিমা বা ওরিয়েন্টাল আর্টে…”

“ওরে বাবা- তোমাগো এইসব শক্ত কথা-বার্তা মুই কিছু কইলাম বুঝব না। কিন্তু, একটা কথা ক’ ত’ রথীন্দ্র- চারুকলায় তুই কাগো সাথে ওঠো-বসো?” এমপি চাচা বেশ আয়েশ করে মালাই চা-য়ে চুমুক দিচ্ছিলেন, “তোর ফেসবুকে তোরে কারা কীসব ট্যাগ করে- সব রাজাকার মার্কা কথা-বার্তা- জামা-কাপড়ে তোগো মতই জিন্স পরে, টি শার্ট পরা- মাইয়াও দেখলাম দুই/একটা জিন্স টিশার্ট পরা- অথচ তোরে ট্যাগ করছে এমন সব লেখায় যেন সব দোষ শুধু আমাগো পার্টির- ভুল-ভ্রান্তি কিছু মোগো থাকতে পারে- কিন্তু তাই বইলা মোরা কী জামাত-শিবিরের চাইয়াও খারাপ?”

 

“চাচা- আপনি এমপির কাজ কইরা আমারে ফেসবুকে কেরা কী ট্যাগায় তা-ও দ্যাখেন নাকি?”

“শোন্- পরের বাড়ি গরু-ছাগল পাইলা বড় হইছি। তোগো মত ভার্সিটিতে চারুকলা না সবরীকলায় পড়ি নাই। কিন্তু মোর মত তৃণমূলে খাইট্যা এমপি কয়জন হইছে দেখা। সবার সব কিছুই আমার দ্যাখতে হয়। তুই আমাগো গ্রামের গর্ব। ভার্সিটিতে পড়ছিস। ভাস্কর্য বানাইয়া তোর নাম ছাপা হয় পত্রিকায়। কিন্তু তোরে ত’ আমি দেখছি তোর জন্মের সময় থাইকা। তোর হাফপ্যান্ট পরা বয়স থাইকা তোরে আমি চিনি। বড় হইয়া গেছিস বইলা ’তুমি’ কই- আবার মনের ভুলে ‘তুই’-ও কইয়া ফেলি! এখন পারলে আমাগো এলাকারও কয়েকজন বীর শহীদরে নিয়া একটা ভাস্কর্য বানা- নাকি তোর ঢাকার ঐ টিশার্ট পর ছল-মাইয়াগুলা আবার তোরে ট্যাগাবে- “ফ্যাসিস্টরা শিল্প-সাহিত্য-ভাস্কর্য কইরা সাধারণ মানুষরে ইসলাম থিকা বিচ্ছিন্ন করতাছে!? ঐ আমি পাঁচ বেলা নামাজ পড়ি না? আমি মুসলমান না? তুই ঢাকায় কাগো সাথে মেশস?”

 

রথীন্দ্র হাসি সামলাতে পারে না, “চাচা- আছে কিছু শয়তান বাম! কিন্তু কী করব কন? ঢাকা ভার্সিটির চারুকলা, ‘ছবির হাট’-এ সব এরা। এরা ত’ নিজেগো কয় ‘বাম’। কতগুলারে যে আন-ফ্রেন্ড করছি। কিন্তু লিস্টের কয়জনরে ফেলায় দেব?”

“থাম- বাম না শয়তান! এই যদি বাম হয়, তইলে জামাত কেরা? এইরে- মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হইয়া যাবে। এখন ক- তুই পিরোজপুরের শহীদদের নিয়া একটা ভাস্কর্য বানাবি কিনা? টাকার জন্য চিন্তা করিস না! শহীদদের মধ্যে ভাগিরথীও থাকবে। আমাগো এলাকার একমাত্র নারী শহীদ। বড় কষ্ট পাইয়া মরছিল। আমরা যারা যারা সেই দৃশ্য নিজ চোক্ষে একবার দেখছি, তারা জীবনেও ত’ ভুলভ না।”

“আমি তাইলে আগে কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়া কাজটা শেষ করি?”

“ঠিক আছে- কর! বিদ্রোহী কবিরে নিয়া কাজ ত’ ভাল কথা।” 

 

 

সেবার স্থানীয় সাংসদের বাড়ি থেকে বের হয়ে, পিরোজপুর থেকে ঢাকায় ফেরার বাসে উঠে বসে বাস যখন ক্রমাগত নদী-মাতৃক বরিশালের একটির পর একটি ফেরি ঘাট পার হচ্ছিলো, রথীন্দ্রর মনে হচ্ছিলো হেমন্ত সন্ধ্যার কুয়াশায় এই বুঝি একের পর এক যত নদী- জলঙ্গী-বলেশ্বর-সন্ধ্যার সর পড়া কুয়াশার জল চিরে উত্থিত হবেন- কে? গঙ্গা অথবা ভাগিরথী? কিন্তু, ‘মহাভারত’-এর মহাবীর ভীষ্মমাতা গঙ্গার ধার-কাছেই বা কীভাবে ঘেঁষবে বিধবা কাজের মেয়ে আর ‘পাঞ্জাবিদের বউ’ হয়ে যাওয়া ভাগিরথী যাকে গাদ্দারির দায়ে বাইকে ছিঁচড়ে, সারা শহর ঘুরিয়ে পরে একটি গুলি করে বলেশ্বরের জলে ফেলে দেওয়া হয়? সেই বাইকে ছেঁচড়ানো ও অসংখ্যবার ধর্ষিত দেহটি? আর বুঝিবা এই দূর-বিস্তৃত যত নদীর সারির কোন একটিতেই নৌকায় বৈঠা ধরে খেয়া পারাপার করছেন খোদ ধীবরকন্যা সত্যবতী! 

 

“মুড়ি- ঝালমুড়ি- ডিমা ডিম! গরম গরম ডিম!” 

 

ঢাকায় ফিরতে ফিরতেই অবশ্য রথীন্দ্র সেই রোজকারের রথীন্দ্রই হয়ে উঠেছিল। চারুকলায় ভাল নম্বর নিয়েও টিচার না হবার দু:খ মাত্র কাটিয়ে উঠে সে ‘ফুলটাইম স্কাল্পটর’- অন্য বন্ধুদের মত পশ্চিমে পিএইচডি করতে যাবার কথা ভাবলেও পর মূহুর্তেই মনে হয়, “দূর ছাই- আমার কাজ ত’ ভাস্কর্য বানানো। এখন আবার আইএলটিএস করতে বসো, টোফেল ক্লাস করো!” তবে ফুলটাইম স্কাল্পটর হয়েও সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে খেয়ে-পরে খারাপও কাটছিলো না। মাঝখানে ক’দিন সংসদ ভবনের ভেতর একটি বিস্তৃত, ফাঁকা জায়গায় বিশাল একটি ভাস্কর্যের কাজ করতে করতে ক’দিন ধরে অকথ্য কাঁধ ও পিঠ ব্যথার সময় ইয়্যারমেট রেজার কথাতেই একটি ফিজিওথেরাপি সেন্টারে গেলে কালো কুচকুচে, বোঁচা নাকের দীর্ঘকায় ও পাতলা ছিপছিপে থেরাপিস্ট, যে ম্যাসেজ করা শুরু করলেই মনে হয় ওর লোহার মত আঙুলগুলোর আন্তরিক স্পর্শে সব কষ্ট নিমিষে দূর হয়ে যাবে, একদিন একটি অদ্ভুত কথা বলে বসে, “আপনি ত’ স্যার মূর্তি বানান, না?”

“হ্যাঁ।”

“কীসের মূর্তি বানান?”

“নানা কিছুর।” 

 

“জানেন স্যার- আমার দেশ কুমিল্লার চাঁদপুরে। আমার বাবার কিন্তু মাছ ধরার বড় নৌকা ছিল স্যার। একদিন মাছ ধরার নৌকা নিয়া- ক্লাস এইটে পড়ি তখন- আমার চাচাতো ভাইরে নিয়া- ও তখন ক্লাস নাইনে পড়ে- বাইতে বাইতে নদীর মুখের কাছে চইলা গেছিলাম- তখন সন্ধ্যা হইয়া আসছে- তখন মনে হইলো য্যানো একটা বিশাল বড় একটা মাছ- কিন্তু মাছটা একটা মেয়ের মত- যেন খুব সরু কোমরের কোন মেয়ে যার নিচের দিকটা স্যার আবার ভারি- কিছু মনে নিয়েন না, স্যার- বড় মেয়ের মত- ক্যামনে কই? একদম মেঘনার মোহনার ঐখানে- যেইহানে সব লঞ্চ ডোবে!”

“কী বলে? আরে- তুমি নেশা-টেশা করেছো নাকি?”

“না-স্যার- সত্যি। আমি আর আমার চাচাতো ভাই ভয়ে উল্টা দিকে বৈঠা টাইনা ফিইরা আসলাম। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে সেই ঘটনা মনে পড়লে মনে হয়- ঐটা কী আসলে একটা মাছ ছিল না মেয়ে ছিল?” 

 

এটুকু বলার পর ম্যাসেজ-ব্যায়াম সব ফেলে রেখে রথীন্দ্র উঠে বসেছিল। 

“তুমি কি মারমেইডের কথা বলছো?”

“না- না- স্যার- কোন বিদেশী গল্পের কথা না। আমি নিজেই ঐরকম একটা দেখছি ত’। আমার চেম্বারে যত রোগী আসে- সবাইরে আমি এই গল্পটা করি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না!”

 

ফিজিওথেরাপিস্টের গল্প শুনতে শুনতে রথীন্দ্রর মনে হলো সে নিজেই যেন এক ধীবর কিশোর হয়ে চাঁদপুরে মেঘনার মোহনার কাছে নৌকা বাইতে গিয়ে সন্ধ্যার আগে আগে এক তীব্র জোয়ারের ভেতর দেখছে সরু কটিদেশ কোন নারীর মত এক মাছকন্যাকে...। সে নিজেই কী নেশা করে এই ক্লিনিকে ঢুকলো নাকি?

 

“রথীন্দ্র পাল বলছিলেন?”

  “জ্বি-বলছি।” 

 “আমি ত্রিশালের কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলছিলাম!”

“জ্বি- জ্বি!”

“তা’ আমরা ত’ নজরুলের কোন গান বা কবিতা বা সৃষ্টিকর্মের ভিত্তিতে ভাস্কর্য গড়ার কাজে আপনাকেই মনোনীত করেছি। এখন কাজ কেমন এগোচ্ছে? কোন্ গান বা কবিতার উপর করবেন ঠিক করেছেন?”

“আমি ভাবছি স্যার খেলিছে জলদেবী গানটি নিয়ে করব!”

“ওকে- মডেল কাকে করবেন ঠিক করলেন?”

“স্যার- একটু ব্যতিক্রমী ভাবে কাজটি করতে চাই। এই ভাস্কর্যে জলদেবীর হাতের একটি মুদ্রা শুধু থাকবে। বাকি দেহ কিছু গড়ব না। তবে এটাই হবে খুব বড় আয়তনে।”

“আচ্ছা- মডেল কাউকে ঠিক করেছেন?”

“চেষ্টা করছি, স্যার। এক সুইডিশ মহিলার সাথে বসলাম ‘বেঙ্গল’ ক্যাফেতে। খুবই সুন্দর হাত- তবে ওদের স্কিন-টোন আমাদের নারীদের স্কিন-টোন থেকে অনেকই আলাদা আর আমাদের এখানে হাতের মুদ্রার থেকে ওদের হাতের ভঙ্গিমা একদমই কিনা অন্যরকম-।”

“তারপর?”

“আরো কিছু মেয়েকে ট্রাই করছি। পছন্দসই কাউকে পাচ্ছি না।”

“রুমঝুম খানকে কেমন লাগে আপনার? অবশ্য আপনাদের চেয়ে বেশ সিনিয়র হবে। আমাদের জেনারেশনের ক্রাশদের একজন ছিলেন কিন্তু।” 

“হা- হা- সেটা ঠিক আছে, স্যার। আর রুমঝুম খান এখনো বেশ সুন্দরী। দীর্ঘকায়া, শ্যামলা-কত্থক শিল্পী না উনি?”

“হ্যাঁ- আপনি ওনাকে ফোন করুন না! আমি নম্বর দিচ্ছি। ওনার নিজেরই একটা অফিস আছে। একটা হোটেলে উনি শেয়ারে মালিক। সেখানেই চলে যেতে পারেন। আপা যদি একদিন আপনাকে মডেল হিসেবে কিছু সময় দেন।”

“ঠিক আছে।”

 

“তারপর দোস্ত- ত্রিশাল ভার্সিটির জন্য খুব বড় কাজ পাইছিস শুনলি?”

“হুম- এই আর কী!”

“নজরুলের কোন্ গান বা কবিতাটির উপর করবি ভাস্কর্য?”

“খেলিছে জলদেবী!”

“ওহ্- আমার কী অনুমান জানিস- নজরুল এই গানটি লর্ড টেনিসনের ‘দ্য মারমেইড’ কবিতা থেকে প্রভাবিত হয়ে লিখেছেন,” কিংশুক একটা সিগারেট ধরায়। 

 

“সেটা কি ঠিক, কিংশুক? নজরুল সমাজের সুবিধা-বঞ্চিত অংশের ছেলে ছিলেন। মানে রবীন্দ্রনাথের মত জমিদার পরিবারের ছেলে ত’ না যে ইংরেজি-পিয়ানো-ছবি আঁকা-সেতার শেখা-ব্যায়াম করা- নানা বিষয়ে নানা গৃহশিক্ষক?” রামীম উত্তর করে। 

“শোন- নজরুলের মত প্রতিভাকে আন্ডার-এস্টিমেট করা ঠিক না। যেসময় রুশ সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ শুরুই হয়নি, সেসময় উনি দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইমস এ্যান্ড পানিশমেন্টে’র উল্লেখ করে প্রবন্ধ লিখছেন। আঠারো থেকে কুড়ি শতকের সব বাঙ্গালী লেখকই অল্প-বিস্তর বিদেশী সাহিত্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন!”

“কিন্তু প্রমাণ?”

 

কিংশুক হাসে, “প্রমাণ হলো: 

Who would be

A mermaid fair,

Singing alone,

Combing her hair

Under the sea,

In a golden curl

With a comb of pearl,

On a throne?

 

পাশাপাশি নজরুলের ভাবনা-ভাষান্তরও কিন্তু সুন্দর: খেলিছে জলদেবী সুনীল সাগর জলে/তরঙ্গ লহর তোলে লীলায়িত কুন্তলে। যাহোক, আজকে রথীন্দ্র আমাদের ট্রিট দিবি কিন্ত। নতুন কাজের কমিশন পাওয়া- সেই যেমন মিকেলেঞ্জেলো বা রদ্যাঁরা পেতো।”

“আর কমিশন! টাকা ত’ খুব বেশি না। তাই কল্পনার সমুদ্র তীর, প্রবালের মালা, মুক্তা- জলদেবীর চুলের কাঁকই, কটিতে মেখলা- সব বাদ। শুধু একটি হাতের মুদ্রাই করব ভাবছি!”

“মডেল কে হবে?”

“আগামীকাল ঐ কত্থক শিল্পী রুমঝুম খানের অফিসে যাব!”

“গুড। আজকে কফির বিল তুই-ই দিবি। আমরা কেউ এক পয়সাও দেব না।” 

“তা’ খা না তোরা- মানা করেছে কে?” রথীন্দ্র হাসে। 

 

রুমঝুম আপার সাথে কাজের সুবাদেই ভালই সখ্য হয়ে গেছিল রথীন্দ্রর। আর সবার মত আপার সাথেও এই যানজটের শহরে মুখোমুখি বছরে এক/আধবার না হোক, ফেসবুকে রোজই দেখা হয়। আপার হাতের মুদ্রার বিশাল ভাস্কর্য ত্রিশাল ভার্সিটিতে স্থাপিত হয়েছে। 

 

“নাহ্- তোমার জন্য আমার হাতের মুদ্রা- আমার নাচ অমরত্ব পেলো। ভারতে যে ইন্সটিটিউটে, যেসব গুরুজীর কাছে কত্থকের তালিম নিয়েছি, সেসবই পূর্ণতা পেলো, রথীন্দ্র! আমাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। তবু তোমরা মানে পরের জেনারেশন যে এখনো আমাদের মনে রেখেছো”-

“না- না- আপা- এ আর এমন কী?”

 

ত্রিশাল ভার্সিটি অবশ্য এখনো রথীন্দ্রকে তার পুরো টাকা শোধ করেনি। তবে রুমঝুম আপার সাথে এই কাজের সুবাদেই ফেসবুকে রোজ দেখা। ক’দিন হয় বসিলায় স্টুডিও-র কাজে যেতে পারছে না রথীন্দ্র। গোটা জুলাই জুড়ে এ কী ঘটে চলেছে? রথীন্দ্রর মাথায় গোলমাল ত’ লেগে যাচ্ছেই, অন্য সবার মত কত্থক শিল্পী রুমঝুম আপাকেও আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা যাচ্ছে। ও বাবা- এটা রুমঝুম আপা কী শেয়ার করেছেন?

 

“ফ্যাসিবাদ যখন শিল্প-সংস্কৃতির নামে কালচারাল ফ্যাসিবাদ জারি রাখে!”

ফ্যাসিবাদের একটি বড় লক্ষণ হলো দেশের গণ-মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে ফ্যাসিস্টরা শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত-নৃত্য, খেলা-ধূলার বছরব্যপী আয়োজনে মানুষকে ব্যস্ত রাখে। গত পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিবাদ তার ‘কালচারাল ফ্যাসিস্ট’দের সহায়তায় এ কাজ করে চলেছে।

 

কোন মন্তব্য করবে না ভেবেও রথীন্দ্র দ্যাখে কখন তার আঙুল কীবোর্ডে সচল হতে শুরু করেছে, ‘সবই বুঝলাম আপা। তাই বলে ভাস্কর্য গড়া বা নৃত্যানুশীলন কী মন্দ?”

উত্তেজিত হয়ে রুমঝুম আপা তার ভাগ্নের বয়সী রথীন্দ্রকে ফোনই করে বসেন, “কী হচ্ছে তুমি দেখছো না, রথীন্দ্র?”

“জ্বি- আপা- সে ত’ দেখছি। কিন্তু-”

“কিন্তু-”

“এই মাত্র এক চিত্রশিল্পী একটি ছবি শেয়ার করেছে। শিবিরের ছেলেরা শাহবাগে!”

“তাতে সমস্যা কী?”

“না- আপা- মানে বর্তমান সরকার ঠিক করছে সব সেটা ত’ বলছি না। ভুল করছে- অনেক ভুল করছে। কিন্তু, শিবির- আপা, আপনার নাচ, আমার স্কাল্পচার-”

“কিচ্ছু হবে না- কিচ্ছু হবে না- ও তুমি কোন চিন্তা করো না। এখানে অনেক বামরাও আছে, বুঝলে? শিল্প-সাহিত্য করা মানুষজনও আছে। চাইলেই কী এই দেশকে আফগানিস্থান বানাতে পারবে নাকি? অত সহজ না! আর আওয়ামী লীগ একাই কি মুক্তিযুদ্ধ আর শিল্প-সংস্কৃতির সোল এজেন্ট নাকি? তুমি বলো?”

“জ্বি-আপা!”

 

বসিলার স্টুডিও কয়েক মাস হয়ে তুলে দিয়েছে রথীন্দ্র। এত খরচ টানা কঠিন। দেড় বছরের উপর তেমন কোন কাজ নেই হাতে। এক শুধু পিরোজপুরে এক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান তার বাবা-মা’র একটি ম্যুরাল বানাতে কিছু টাকা দিয়েছিল। রথীন্দ্রর বউ ওয়ার্কিং ওম্যান নয়। কীভাবে যে সংসার চলছে! শুধু এখনো তারা কোন বাচ্চা-কাচ্চা নেয়নি। এরই ভেতর স্টুডিও থেকে অনেক শেষ না হওয়া ভাস্কর্য আবার উল্টো প্রচুর পয়সা খরচ করে, পিরোজপুরে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হয়েছে। সত্যি বলতে, গত বছর পাঁচই আগস্টই রাত ন’টা-দশটায় এলাকা থেকে ফোন এসেছিল। 

 

“এখানে শহরের ক্রীড়া স্টেডিয়ামে আপনার করা বাংলা নববর্ষের সময়ে উদ্বোধন করা ভাস্কর্যটা ভাঙতে হাজার হাজার মাদ্রাসার ছাত্র চইলা আসছে!”

“সর্বনাশ!”

“আর্মিতে আমার এক চাচাতো ভাই আছে। তারে ফোন দ্যান”- এলাকার শিল্পপ্রেমী ছেলেটি যে তাকে ফোন করেছিল, সে ঝটাপট তার চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বর দিলে রথীন্দ্র সাথে সাথে ফোন করেছিল।

“বুঝতে পারছি- বুঝতে পারছি। কিন্তু কীভাবে হেল্প করি তা’ ত’ বুঝছি না।”

 

ভাগ্য গুণে ভাস্কর্যটি বেশ বড় আয়তনের ছিল বলে পুরোটা ওরা ভাঙ্গতে পারেনি। পায়ের কাছে কিছুটা ভেঙ্গেছে। এই অক্টোবরে পূজার সময় বাড়িতে গেলে পরিচিত বেশ কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্র হাসি হাসি মুখেই তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “দাদা- কী দিয়া বানাইছিলেন? আমরা অনেক গুঁতা-গুঁতি কইরাও পুরা ভাঙ্গতে পারি নাই! শুধু পা একটা ভাঙ্গছি!”

রথীন্দ্র আর কী করে? একথার উত্তরে বোকা বোকা একটি হাসি শুধু মুখে ঝুলিয়ে রেখেছিল।

 

কিন্তু বিধাতা পুরুষ তার ভাগ্যে আরো কিছু লিখে রেখেছিল। এ বছরের জুলাই আসতে আসতে প্রথম ফোনটি রথীন্দ্রকে করেন খোদ রুমঝুম আপা। 

“রথীন্দ্র- খবর জানো?”

“না- মানে কী হয়েছে, আপা?”

“ত্রিশালে তুমি আমার হাতের মুদ্রা নিয়ে যে ভাস্কর্যটি গড়েছিলে- সেটা ভেঙ্গে কারা যেন ভেঙ্গে ফেলেছে!”

মোবাইলে নামী কত্থক শিল্পী, শৈশবে টিভি পর্দায় দেখা সেই তরুণী কত্থক শিল্পীর ফোঁপানো কান্নার শব্দ কানে আসে। নিজের হাতে গড়া ভাস্কর্য ভাঙ্গার খবরে বিষাদে আক্রান্ত হতে হতে কেমন এক অদ্ভুত পাশবিক একটি উল্লাসও যেন এই প্রথম রথীন্দ্র নিজের ভেতর বোধ করে!

 

উত্তরে অবশ্য শুধু বলে, “জ্বি- আপা!”

“কী হবে বলো ত’? চলো- একবার ত্রিশালে যাই! আমিই তোমাকে আমার গাড়িতে পিক-আপ করে নেব।”

 

ত্রিশালে ‘খেলিছে জলদেবী’-র হাতের মুদ্রার সামনে দাঁড়িয়ে- বিশ ফুট ভাস্কর্যের হাতের একটি আঙুল যেখানে পাঁচ ফুট- অত বড় ভাস্কর্যর গুঁড়িয়ে যাওয়া চেহারা দেখে রুমঝুম খান চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন না! 

 

“এটা কী হলো, রথীন্দ্র? সব ত’ নতুন বন্দোবস্ত হবার কথা ছিল।” 

“জ্বি- আপা। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ, দায় ও দরদের সরকারও হবার কথা ছিল।”

“অথচ সব মাজার ভাঙ্গছে- বাউলদের মারছে।”

“আপা- ঢাকা ফিরতে আবার ডবল রাস্তা কিন্তু।”

 

রুমঝুম আপা এই বয়সেও অসামান্য সুন্দরী। তাঁর কালো চোখ দেখলে এখনো মনে হবে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সেই দুই পংক্তি: “আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্নি”-দ্য ভিঞ্চি ‘মোনালিসা’ বানাতে যে মডেলের সাথে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছিলেন- রথীন্দ্রর মডেল অবশ্য এই মূহুর্তে ঝরঝর করে কাঁদছেন। কেঁদে-কেটে শান্ত হবার পর, ত্রিশালেই একটি ক্যাফেতে কিছু খেয়ে আপার গাড়িতে উঠে আবার ঢাকার পথের দিকে যাত্রা। ক্লান্ত কত্থক শিল্পী গাড়ির দীর্ঘ পথে ঘুমিয়ে পড়েন। ত্রিশাল ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ শালা তাকে এখনো কাজের পুরো বিলটিই দিল না।

 

এদেশে আর ভাস্কর্য। দূরে কোথাও পড়তে চলে যাওয়া যেত- যা এত দিন সে যায়নি! ভাস্কর্য গড়ার নেশায়। আর ভাগিরথী? গঙ্গা? দ্য লিটল মারমেইড? বলেশ্বরের জলে গুলিবিদ্ধ যে তরুণী বিধবাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল? রাজা শান্তনুর স্ত্রী গঙ্গা যিনি সব গর্ভজাত নবজাতককে নদীতে বিসর্জনে পূর্বজন্মেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ? চাঁদপুরে মেঘনার মোহনায় সরু কটিদেশ নারীর মত যে দীর্ঘ মাছমেয়েকে দেখে উল্টো নৌকার দাঁড় বেয়ে পালিয়ে এসেছিল যে ধীবর কিশোর- পৃথিবীর সেই সব বিলুপ্ত জলদেবীকে কবে পাথরে কুঁদে কুঁদে তৈরি কবরতে পারবে আর রথীন্দ্র?

 

১৬/১২/২০২৫

সব খবর