শহরের এই অংশটা মোটেও নির্জন নয়, কিন্তু এই গলির এই প্রান্তটা একটু নির্জনই বলা যায়; বাসাগুলোতে সজীবতা খুব কম। কেউ চিৎকার করে কাউকে গালি দেয় না, কোন বাচ্চা গলা ছেড়ে কাঁদে না, পাশের বাসার মহিলার সঙ্গে খাজুরে আলাপ পারতে যায় না অন্য কোন বাসার মহিলা; গলির এই অংশটায় কেমন যেন একটা একাকীত্বের ব্যঞ্জনা আছে। আর তাই গলির প্রায় শেষপ্রান্তের বাসাটার দিকেও কেউ খেয়াল করে না। খেয়াল করলে দেখতো, বাসাটায় কেবল একজন থাকে, লম্বা ঢ্যাঙা আর মাথার সামনের দিকে একটু একটু করে টাক উঁকি দিতে থাকা ত্রিশের কোঠার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগোতে থাকা রফিক, একা। দিনে একবার সে বের হয়, বাজার করে আবার ঘরে চলে যায়। এমন কিছু আহামরি বাজারও সে করে না। তবে মনে হয় সে রুটি খুব পছন্দ করে; তার বাজারের ব্যাগে প্রায়ই অনেকগুলো রুটি দেখা যায়।
ঢাকার মত শহরে, যেখানে হাজার মাথা কুটলেও ব্যাচেলর একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে পারে না, সম্ভবত বাড়িওয়ালারা তাদের ব্যাচেলর-জীবনের স্মৃতি মন্থন করে তাদের কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে শঙ্কিত বোধ করে, সেখানে রফিক একটা আস্ত বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে- ব্যাপারটার মধ্যে একটা বিশাল বিস্ময়ের ব্যাপার আছে; কিন্তু এলাকাটায় একটা একাকীত্বের ব্যঞ্জনা আছে, তাই তাকে এ নিয়ে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় না। সে বাড়িটায় রাজত্ব করতে থাকে। আর এলাকার একাকীত্বের ব্যঞ্জনার সদ্ব্যবহার করে বাড়ির নিচতলার মেঝে খুঁড়ে গর্ত করে, আর সেখানে লুকিয়ে রাখে আস্ত একজন লোককে। সে তাকে খুন করবে।
এর আগে সে কাউকে খুন করেনি, তবে এই লোকটাকে নিশ্চিতভাবেই খুন করবে। তবে এ কাজের জন্য সে কোন বন্দুক জোগাড় করেনি, লোকটার মাথা বরাবর একটা বুলেট ছুঁড়ে বজ্রের মতো প্রচণ্ড আর দ্রুত মৃত্যু তাকে সে দেবে না। ছুরি দিয়ে লোকটার বুক ফেঁড়ে দিয়ে লাল রক্ত ঝরতে দেখে পুলকিত হবে না সে, সেই মৃত্যুও বড় দ্রুত। না খেতে দিয়েও সে লোকটাকে মরতে দেবে না, সেই মৃত্যুও বড় দ্রুত। আসলে সে কেবল ঠিক করেছে লোকটাকে মারবে, অপহরণের ৬৩তম দিনে সে লোকটিকে খুন করবে। কিভাবে মারবে তা সে এখনো ঠিক করেনি, করতে পারে নি। তাতে কিছু আসে যায় না, মারার সিদ্ধান্ত নেয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ; কিভাবে মারবে সেটা পরেও ঠিক করা যাবে। সে এই লোকটাকে ঠিকই খুন করবে; নিশ্চিতভাবেই খুন করবে।
গর্তের সামনে একটা কাঠের চেয়ারে বসে রফিক কী যেন চিন্তা করছিল, হঠাৎ তার চিন্তার গতি হোচট খেল নিচের লোকটার গলার ঘর্ঘর আওয়াজে। কয়েকদিন হয়ে গেছে, লোকটা আর কোন কথা বলতে পারছে না, কেবল গলা দিয়ে ঘর্ঘর শব্দ বের হচ্ছে। রফিক অবশ্য লোকটাকে একবারও চিৎকার করতে নিষেধ করেনি। ও খুব ভাল করেই জানত, চিৎকার করে লাভ নেই, কেউ সেই চিৎকার শুনতে পারবে না। ও আরো ভাল করে জানে, এমন অসহায় অবস্থায় মানুষ কতোটা অমানুষিক শক্তি দিয়ে চিৎকার করে, আর তা কতো দ্রুত মানুষকে বিধ্বস্ত করে ফেলে। সে তাই পুরো ব্যাপারটা খুব বেশি করেই উপভোগ করে, লোকটার প্রাণপণে চিৎকার করা দেখে তার ঠোঁটের কোণে একচিলতে নিষ্ঠুর হাসি ঝুলে থাকে। মাঝে মাঝে সে হাততালি দিয়ে লোকটার দিকে কয়েকটা পাঁচ টাকার কয়েন ছুঁড়ে দেয়, আরো জোরে চিৎকার করতে বলে, আর তারপর নিজেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে। রফিকের ছুঁড়ে দেয়া কয়েনে মিশে থাকা বিদ্রূপ লোকটাকে কিছুক্ষণের জন্য চুপ করিয়ে দেয়, রফিকের চিৎকার লোকটাকে আরো ভীত করে তোলে। কিন্তু গর্তের ভেতর লোকটার আসলেও কোন কাজ নেই, এমনকি তার বসারও কোন উপায় নেই; গর্তের মধ্যে অবশ্য বসার মত যথেষ্ট জায়গা আছে, তবে মলমূত্র ত্যাগের কোন জায়গা নেই, আর তাই গর্তের মধ্যেই তাকে মলমূত্র ত্যাগ করতে হয়েছে। সেগুলো গর্তের একপাশে স্ত্তপ হয়ে আছে, সেগুলো গর্তের মাঝে বিশ্রীরকমের গন্ধ ছড়াচ্ছে, তবে গন্ধে তার তেমন কোন সমস্যা হয় না, মানুষের নাক কিছুদিনের মধ্যেই মলমূত্রের গন্ধকেও সহ্য করে ফেলতে পারে; কিন্তু মানুষের ত্বক অতো দ্রুত তা করতে পারে না। আর তাই সে তখনো বসতে পারত না, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকত আর একটু পরপর চিৎকার করত।
সেটা কিছুদিন আগের কথা। এখন সে আর চিৎকার করতে পারে না, গলা দিয়ে কেবল ঘর্ঘর শব্দ বের হয়। এ কয়দিনে তার মধ্যে আরো একটা পরিবর্তন এসেছে, তার ত্বকও এখন মলমূত্রকে সহ্য করতে পারে, তাই এখন আর তাকে সবসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, সে এখন বেশিরভাগ সময় বসেই কাটায়, তার চোখ গর্তের দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি মুখস্থ করে ফেলেছে, গর্ত থেকে দেখা যাওয়া একটুখানি ছাদও মুখস্থ করে ফেলেছে, তবু সেগুলোই সে সারাদিন বসে বসে বারবার নতুন করে দেখতে থাকে। আর যখন খুব বেশি খিদা লাগে কিংবা গলা খুব বেশি শুকিয়ে যায়, আর সহ্য করতে পারে না, তখন এমনি করে ঘর্ঘর আওয়াজ করে। রফিক কাছাকাছি থাকলে তা শুনতে পায়, এখন যেরকম শুনতে পেয়েছে।
রফিকের জন্ম হয়েছিল একটি মফস্বল শহরে। পরিবারের বড় ছেলে সে, ঘাড়ে চেপেছিল কৃষক বাবার অপূর্ণ সাধ-আহ্লাদ আর ছোট ভাই-বোনদের দায়িত্ব; কিন্তু সেই সাধ-আহ্লাদ আর দায়িত্ব পূরণ করার মত মেধা কিংবা ধূর্ততা, কোনটিই তার ছিল না। পাড়ার স্কুল আর স্থানীয় কলেজ থেকে পড়াশুনা করে সে অনার্সে ভর্তি হয় স্থানীয় কলেজেই, মানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর যেহেতু তার তেমন মেধা বা ধূর্ততা কোনটাই ছিল না, সুতরাং সে এমন কোন হাতি-ঘোড়া রেজাল্টও করতে পারেনি; তাই সে এমন কোন হাতি-ঘোড়া চাকরিও জোটাতে পারেনি যা দিয়ে তার কৃষক বাবার অপূর্ণ সাধ-আহ্লাদ আর ভাই-বোনদের দায়িত্ব নিতে পারবে তার গ্রাম্য চওড়া মজবুত কাঁধে। শুধু শুধু সে কতোগুলো টাই কেনে, লন্ড্রিতে শার্টের ইস্ত্রি খরচ বাবদ মাসে মাসে বেশ কিছু টাকা গচ্চা যায় আর বন্ধুদের কাছ থেকে জুতা ধার নিতে নিতে বন্ধুমহলে তার নাম হয়ে যায় ‘জুতা রফিক’; দূর থেকে তাকে দেখলেই বন্ধুরা হিসেব করতে শুরু করতো, এবার কার জুতা ধার দেবার পালা। কিন্তু সে সুদূর অতীতের কথা; আপাতত সে একটি আস্ত বাড়িতে রাজত্ব করছে, আর তার নিচতলার মেঝেতে গর্ত খুঁড়ে একটি আস্ত লোককে আটকে রেখেছে; সে লোকটিকে খুন করবে; আর খুন হতে যাওয়া লোকটি আপাতত তার কাছে গলায় ঘর্ঘর শব্দ তুলে পানি নয়তো খাবার চাচ্ছে; তাকে খাওয়ানো দরকার, না খেয়ে মারা গেলে রফিক শান্তি পাবে না, সে তাকে খুন করবে, নির্মম ভাবেই খুন করবে, যেভাবে খুন করলে সেটাকে সত্যিই নির্মম বলা যায়।
গর্তের কাছে যেতেই গন্ধে রফিক নাক চেপে ধরে সরে এলো; লোকটির মল দুর্গন্ধময়, গন্ধে গর্তের কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। সে গর্তে পানি ঢেলে দেবে কিনা চিন্তা করে। কিন্তু গর্তটাতো আর কমোড নয়, তাতে তো কোন স্যানিটারি লাইন নেই যে পানি ঢাললেই সব পরিস্কার হয়ে যাবে। সে নাক চেপে গর্তের কাছে এসে লোকটিকে একটি অশ্রাব্য গালি দিয়ে জিজ্ঞেস করে সে কেন ঘর্ঘর করছে। লোকটি ইঙ্গিতে পানি খেতে চাইলো। লোকটির পিপাসা লাগারই কথা, কাল রাতের পর থেকে এখন পর্যন্ত সে লোকটিকে কিছুই খেতে দেয়নি। তৃষ্ণার্ত লোক পানি খেতে চাইছে, পানি খাওয়ালেই বেহেস্তে মোহরাঙ্কিত পাত্রে শুরা পাওয়া যেতো, কিন্তু রফিকের চোখে হুরপরীর হাতে ধরা মোহরাঙ্কিত পাত্রভরা শুরার ছবি ভেসে ওঠে না, হয়তো তার জায়গায় অন্য কোন ছবি ভেসে ওঠে, সে লোকটিকে অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে লোকটির মুখ লক্ষ্য করে মুততে শুরুটি করে।
লোকটি সরে যায়, কিন্তু গর্তটা খুব একটা বড় নয়, ছোটই, রফিকের উষ্ণ প্রস্রবণধারা তাকে অনুসরণ করতে থাকে, ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় বারবার রফিকের উষ্ণ প্রস্রবণধারার জয় হতে থাকে; তবে সুখের কথা হল, রফিককে বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী বললেও সে শেষ পর্যন্ত মানুষই থাকে, আর মানুষ কখনোই দীর্ঘকাল ধরে মুততে পারে না, তাই রফিকের উষ্ণ প্রস্রবণধারাও একসময় বন্ধ হয়, লোকটি কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে। তারপর সদ্য ভেজা মানব বর্জ্যের ওপর থপ করে বসে পরে।
লোকটির এভাবে বসে পরা দেখে রফিকের ওর বাবার এভাবে বসে পরার কথা মনে পরে যায়; ওর বাবা যেদিন শুনেছিল রফিক ওদের শেষ জমিটাও বিক্রি করে দিয়েছে, সেদিন সেও এভাবেই থপ করে বসে পরেছিল, তবে ওর বাবা বসেছিল তাদের বাসার বারান্দায়, কোন বাসার নিচতলায় খোঁড়া মলমূত্রভরা গর্তে নয়। অবশ্য পরক্ষণেই সে উঠে দাঁড়িয়েছিল, ভেবেছিল, তার ছেলে শিক্ষিত, তার মত মূর্খ চাষা নয়। সে যা করছে, ভালোই করছে। কিন্তু তারমতো তার ছেলে উঠে দাঁড়াতে পারেনি; আসলে তাকে উঠে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি, তাকে তেমন ভাবেই বসিয়ে দেয়া হয়েছিল, যেভাবে বসিয়ে দিলে আর কেউ কখনো উঠে দাড়াতে পারে না।
উঠে দাড়াতে না পারলেও রফিক নপুংসক নয়; নিভে যাবার আগে শেষবারের মত সে দপ করে জ্বলে উঠেছে, আর সেই দপ করে জ্বলে ওঠার বিকৃত আগুনে অবিরাম পুড়ে যাচ্ছে গর্তের লোকটি। তার দিকে তাকিয়ে রফিকের মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠে, প্রচণ্ড হয়ে জ্বলে ওঠে ক্রোধ; সে বদ্ধ মাতালের মত লোকটির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে, তাকে গালিগালাজ করতে থাকে, রফিকের এই মাতাল রূপ দেখে লোকটি ভয় পেয়ে যায়, তার মনে হয় এখুনি রফিক তাকে খুন করবে; কিন্তু সে জানে না, তার মরতে এখনো অনেক দেরি, ঠিক ৬৩ দিনের মাথায় রফিক তাকে খুন করবে, ঠিক ৬৩ দিনের মাথায়; অবশ্য কিভাবে খুন করবে তা এখনো সে ঠিক করেনি; সে নিয়ে ভাববার জন্য হাতে এখনো অনেক সময় আছে। আপাতত রফিক তার অতীতের কথা ভাবতে থাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসের মত রফিকের ইতিহাসকেও অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা যায়; আরঅনেক সরকার যেমন তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ইতিহাসের নির্দিষ্ট অংশের বাইরের ইতিহাসকে অম্লান বদনে অগ্রাহ্য করে যায়, তেমনি রফিকের ইতিহাসের অনেক অংশই অগ্রাহ্য করা যায়; সেগুলোর কোন গুরুত্বই নেই। কেবল গুরুত্বপূর্ণ তার বাবার থপ করে ঘরের বারান্দায় বসে পড়া, তারপর আশায় বুক বেঁধে উঠে দাঁড়ানো আর রফিকের বসে পড়ে আর উঠতে না পারা। তবে সে ওঠার জন্য চেষ্টাও করেনি; কারণ তার আর চেষ্টা করারও কোন উপায় ছিলো না; তাকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করারও কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। তাদের শেষ জমিটাও বিক্রি করে দেয়ায় তাদের কৃষক পরিবারের আর কোন মূলধনও ছিলো না; আর তাকে দিয়ে যে চাকরি হবে না, সেটা বুঝতে তার আর টাই কেনার কিংবা শার্ট ইস্ত্রি করার দরকার নেই; রফিকের বাবার মতো রফিকের কোন রফিকও নেই, তাই সে বসে পড়লেও আশায় বুক বেঁধে ফের উঠে দাঁড়াতে পারে না। তবে সে নপুংসক নয়, তাই সে বসেও থাকে না; সে প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হয়ে ওঠে; বাসায় বাপের সামনে গিয়ে মুখ দেখানোর মুখ না থাকলেও সে রহমান সাহেবের মুখোমুখি হয়; তাদের শেষ জমি বিক্রির টাকাটাও সে তুলে দিয়েছিলো এই রহমান সাহেবের হাতে, তুলে দিয়েছিল পরম নির্ভরতায়, তুলে দিয়েছিল চরম বিশ্বাসে; কিন্তু এখন কলিকাল, বিশ্বাসে আর বস্তু মিলায় না, কেবল মিলায় বিশ্বাসঘাতকতা! তবে রহমান সাহেব পুরোপুরি বিশ্বাসঘাতকতা করে না; এ-ও কলিকালের ফ্যাশন, সত্য এখন আর বলাই হয় না, তাই বলে মিথ্যাও বলা হয় না, মিথ্যাকে সত্যের সঙ্গে মিশিয়ে বেশ আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করাই কলিকালের রীতি; রহমান সাহেব তাকে ঠিকই বিদেশে পাঠায়, কিন্তু যেখানে পাঠানোর কথা সেখানে পাঠায় না; যেভাবে পাঠানোর কথা সেভাবেও পাঠায় না। আর তাই শেষমেশ অসাধ্য সাধন করে যখন রফিক লাশ না হয়েই দুই বছরের মাথায় শুকিয়ে আধমরা হয়ে দেশে ফিরে আসে, সে বাসায় না গিয়ে উপস্থিত হয় রহমান সাহেবের বাসায়। দুই বছর না খেতে পেলেও রফিক অভিজ্ঞতা পেয়েছিলো ঢের, আর তাই দিয়ে সে রহমান সাহেবকে নিয়ে আসে এই বাসায়; তার আগে অবশ্য অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই বাসাটা জোগাড় করতে হয়, আর খুঁড়তে হয় গর্তটা।
নাঃ, রহমান সাহেবের মনে হয় আসলেও অনেক তৃষ্ণা লেগেছে, আবারও ঘর্ঘর করতে শুরু করেছে। দেখে খুব মায়া হয় রফিকের, সে এবার আর মুতে দেয় না; অবশ্য চাইলেও সে এবার মুততে পারতো না, যদি তাকে আমরা বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারীও বলি, তবুও তো সে মানুষ, এতো ঘন ঘন মুততে হলে তাকে বহুমূত্র রোগী হতে হতো। সে এবার টয়লেটে গিয়ে কমোডের পানি একটা মগে ভরে নিয়ে আসে, তারপর খুব যত্ন করে একটা দড়ি দিয়ে সেটা রহমান সাহেবের হাতে পৌছে দেয়। আর রহমান সাহেব সেই পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলে, তার তৃষিত হাড়-মাংস মুহুর্তের মধ্যে সেই পানি শুষে নিলে সে অট্টহাসিতে ফেটে পরে। হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরতে নিলে তার মনে পরে, রহমান সাহেবকে খাবার দিতে হবে।
ঘরটির এক কোণে অনেকগুলো রুটির প্যাকেট পরে ছিল, তারমধ্যে বেছে বেছে পুরোনো একটা তুলে নেয় সে। ছুরি দিয়ে খুব সুন্দর করে সেটাকে দেড় ফালি করে। তারপর একটা বাক্স থেকে জুতসই দেখে একটা মরা টিকটিকি বের করে তারমধ্যে ভরে দেয়। এবার রুটিটাকে হালকা আঁচে কিছুক্ষণ গরম করে সেই কমোডের পানির চেয়েও যত্ন করে রহমান সাহেবকে খেতে দেয়। আর খেতে খেতে একসময় রহমান সাহেব মরা টিকটিকিটাকে আবিষ্কারও করে ফেলে; কিন্তু টিকটিকিটাকে ফেলতে পারলেও সে রুটিটাকে ফেলতে পারে না, দিনের দুইটি রুটির একটাতে যদি মরা টিকটিকিও থাকে, তবুও তো ওটাই খেতে হবে! তবে রহমান সাহেব যখন টিকটিকিটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহুর্ত অবাক বিস্ময়ে জুতসই মরা টিকটিকিটার দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন সেই দৃশ্য দেখে রফিক আবার অট্টহাসি হাসতে শুরু করে।
এমনি রফিকের অট্টহাসি আর রহমান সাহেবের গলার ঘর্ঘর শব্দের মধ্য দিয়ে রহমান সাহেব তার বন্দীজীবনের ৬৩তম দিনের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন; তার বন্দীজীবনের ৬৩তম দিনের দিকে, যেদিন তার মহাপ্রয়াণ ঘটবে। রফিক অবশ্য এই দিনের ব্যাপারে খুবই সাবধানী, সে ঘরের দেয়ালের একটা জায়গায় পেন্সিল দিয়ে দাগ কেটে কেটে দিনের হিসাব রাখছে; সে চায় না রহমান সাহেবের মৃত্যু কোনভাবেই ৬৩তম দিনের আগে বা পরে হোক। আর যেহেতু রহমান সাহেবের আর কোন কাজ নেই, আত্মবর্জ্যের উপর বসে থাকা আর তার ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে যা যা আছে সেগুলোই বারবার পর্যবেক্ষণ করা ছাড়া, সুতরাং রফিকের এই দিন গণনার ব্যাপারটা হয়তো সে এতোদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছে; না করলেও হয়তো তা করে ফেলবে, এই সাফল্য অর্জনের জন্য এখনো তার হাতে ৩৫ দিন সময় আছে।