সর্বশেষ

আমার সোনার বাংলা কেন বাংলাদেশের জন্য অনন্য?

প্রকাশিত: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৫:৩০
তবে কেবল সে কালিক উপযোগই নয়, এই গানটির আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার আরো ব্যাপকতর গভীরতর তাৎপর্য আছে। এই গানটি বাংলাদেশের জন্য কেন এতটা উপযুক্ত, তা বোঝার জন্য আমাদের গানটির কথা ও সুরের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
আমার সোনার বাংলা কেন বাংলাদেশের জন্য অনন্য?
বিডি ভয়েস গ্রাফিক্স

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই দেশের প্রতীক, চিহ্ন আর পরিচয়গুলোকে নতুন করে নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখনকার নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিল, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক পরিচয়েরও দৃঢ় প্রকাশ দরকার। জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক, জাতীয় সংগীত—সবকিছুই তাই বেছে নেয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাংলার ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে।


এই প্রেক্ষাপটে আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটি কোনো আকস্মিক বা তাড়াহুড়ো করে নেয়া সিদ্ধান্ত ছিল না। বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রায় গানটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে এই গানটি প্রতিরোধ ও প্রেরণার প্রতীক হয়ে ওঠে। কারণ এটি কেবলই একটি গান নয়, বরং বাংলার প্রকৃতি, বাংলার মানুষের মমতা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতিচ্ছবি। যা একই সঙ্গে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, লোকসংস্কৃতি ও মাতৃভূমির প্রতি আবেগ—সবকিছুকে একসূত্রে বেঁধে দেয়। সব মিলিয়ে, আমার সোনার বাংলা জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যাত্রার ধারাবাহিকতায়।
 

তবে কেবল সে কালিক উপযোগই নয়, এই গানটির আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার আরো ব্যাপকতর গভীরতর তাৎপর্য আছে। এই গানটি বাংলাদেশের জন্য কেন এতটা উপযুক্ত, তা বোঝার জন্য আমাদের গানটির কথা ও সুরের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।
 

প্রথমেই আসা যাক গানের কথায়, চিত্রকল্পে। আমার সোনার বাংলা কোনো আঞ্চলিক বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের উপস্থাপন নয়, বরং সমগ্র বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের আবেগকে একসঙ্গে বাঁধা এক অনন্য রচনা। এ গানে সামগ্রিক বাংলার প্রকৃতিকেই, তার সম্যক সৌন্দর্য, শস্যসমৃদ্ধ মাঠ, নদী, হাওয়া সবকিছুকে নিয়েই, মা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে ‘মা’ সবচেয়ে অন্তরঙ্গ, সবচেয়ে শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রতীক। তাই তো মায়ের “মুখের বাণী” শুনতে “সুধার মতো” লাগে। সেই কারণেই মায়ের “বদনখানি মলিন হলে” তার কষ্ট আমাদেরও জর্জরিত করে, আমরা “নয়ন জলে ভাসি”। এই দু’টি পঙ্‌ক্তি কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, সন্তানের চোখে মাতৃভূমির আনন্দ-দুঃখের অংশীদারিত্বকে তুলে ধরে। দেশ যেমন সন্তানের কাছে গর্বের, তেমনি তার দুঃখে আমরা কাঁদি—এই দ্বৈত অনুভূতিই জাতীয় সংগীতের প্রাণ।
 

এরপর আসে গানটির সুর। গুরুত্বপূর্ণ এই দিকটি আমরা প্রায়ই এড়িয়ে যাই। রবীন্দ্রনাথ এর সুরটি নিয়েছিলেন গগন হরকরার বাউল গান আমি কোথায় পাব তারে থেকে। বাউল গান আমাদের লোকসংস্কৃতির গভীরতম স্তর; যেখানে ধর্মীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ, প্রকৃতি আর আধ্যাত্মিকতার এক অন্তরঙ্গ যোগ তৈরি হয়। বাউল গান নিছক বিনোদন নয়, এটি প্রান্তিক মানুষের জীবনবোধ, মরমী সাধনা আর হাজার বছরের সংস্কৃতির বাহক। বাংলার মানুষের অন্তর্গত জীবনবোধ, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, প্রান্তিক মানুষের আনন্দ-বেদনা—সব কিছুর মিলন ঘটে সেখানে। সেই বাউল সুরের ভেতরেই আছে এক প্রাচীন, অন্তরঙ্গ পরিচিতি। তাই আমার সোনার বাংলা শুনলেই সেটি এত সহজে হৃদয়ে গেঁথে যায়, এত পরিচিত, এত স্বাভাবিক লাগে। কারণ এর সুর আবহমান বাংলার নিজস্ব সাংস্কৃতিক সুর।
 

এই বাউল সুরের উপর রবীন্দ্রনাথের কথা যুক্ত হয়ে, একদিকে লোকসঙ্গীতের আত্মা, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের কাব্যিকতা, দুইয়ে মিলে এমন শিল্পকর্ম সৃজন হয়েছে, যা বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির খাঁটি প্রতিচ্ছবি। হয়ে উঠেছে সমগ্র বাংলার সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশ। আমার সোনার বাংলা তাই শুনতে যেমন সহজ ও স্বাভাবিক, তেমনি অনুভবে ভীষণ গভীর। লোকসঙ্গীতের প্রাণস্পন্দন আর রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক বর্ণনার মিশ্রণই এই গানকে বাংলাদেশের মানুষের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি বানিয়েছে।
জাতীয় সংগীত হিসেবে এই গানটির নির্বাচন যে দীর্ঘ সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যাত্রার ফলেই হয়েছিল, সে আগেই উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও স্রেফ একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল ছিল না। এর পেছনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক এক বিশাল প্রেক্ষাপট কাজ করেছিল। যার শুরুটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলন থেকে। রাজনৈতিক আন্দোলনও তারই অংশী ছিল। সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী অংশীই ছিল তা। কিন্তু সঙ্গে অংশী ছিল সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনও। তারাও সকলেই আমার সোনার বাংলাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে ধারণ করেছিলেন। তাই আমরা দেখি, জহির রায়হান জীবন থেকে নেওয়া ছবিতে এই গান ব্যবহার করেছিলেন এক প্রতিরোধী ও প্রেরণাদায়ক সংগীত হিসেবে।
 

আজও এ গান বাজলে মানুষের হৃদয়ে যে আবেগ সৃষ্টি হয়, তা কোনো কৃত্রিম প্রভাব নয়, বরং শত বছরের সাংস্কৃতিক স্মৃতি ও মমতার প্রতিফলন। এ গান বাংলাদেশের প্রকৃতি, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের সম্মিলিত চেতনার কণ্ঠস্বর। এ এমন এক সুর, যা আমাদের লোকসংগীতের প্রাণস্পন্দন থেকে উঠে এসেছে। এ এমন এক কাব্যিক রচনা, যা মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা ও সৌন্দর্যে রূপ দিয়েছে। তাই যদি কেউ এ গান শুনে নিজের মাটি, মানুষ ও সংস্কৃতিকে অনুভব না করেন, তবে তা আসলে তাঁর নিজের সাংস্কৃতিক শিকড়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সব খবর