পথ যে এমন জটিল হতে পারে ঘৃতকুমারীর সেটা জানা ছিলো না। বেশ চলছিলো সে তরতর করে, তারপর হঠাৎ ডাল পালা সব উধাও। আর কে না জানে মসৃণ পথে এগিয়ে চলা কতবড় দুঃসাধ্য একটা কাজ! অবশ্য পথটাকে পুরোপুরি মসৃণ বললে কিঞ্চিৎ ভুলই হবে, কেননা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বেশ কিছু খোড়ল, কাঠ ঠোকরাদের কীর্তি। এমন তিনটে খোড়লে খুর ঠেকিয়ে চতুর্থটির খোঁজে পা বাড়ালো ঘৃতকুমারী। কানের পাশে অবিরাম ভনভন করে চলা একটা নীল ডুমো মাছিকে লেজের ঝাপটায় ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার ভাবনাটা অনেক কষ্টে দমন করেছে সে। কল্পতরুতে উঠার সময় লেজ সংযত রাখা প্রয়োজন, নইলে ভারসাম্য থাকে না।
আলগোছে মাথা ঝাকিয়ে মাছিটাকে তাড়াতে গিয়েই ঘৃতকুমারীর চোখ পড়লো আকাশে। সেখানে জাবনার থালার মতো গোল আর ঘোলাটে ঘোলাটে একটা চাঁদ। যে চাঁদে চোখ রেখে একদিন চন্দ্রাহত হয়েছিল ঘৃতকুমারীর মা আয়তলোচনা। নিস্তরঙ্গপল্লীর কেউ আর তাকে দেখেনি কোনদিন। নীলাম্বু আর কাঞ্জির ধারণা আয়তলোচনা গিয়েছে হরিদ্রাক্ষপুরে।
হরিদ্রাক্ষপুর স্বপ্নের জায়গা। নিস্তরঙ্গপল্লীর প্রতিটি গরুর স্বপ্ন অন্তত একটিবারের জন্য হলেও হরিদ্রাক্ষপুরে যাওয়া।
এই যাত্রায় গেরস্তদের খরচা অনেক। গরু নিয়ে তিরিশ ক্রোশ হাঁটা, সেখানে পৌঁছোবার পর অপেক্ষা নিদেন পক্ষে এক চাঁদের। গরুময় গ্রাম তো আর একটা দুটো নয়!
যত অপেক্ষা তত খরচ, খাবার খরচ, থাকার খরচ। গেরস্তদের তো বটেই, তারচে বেশি খরচ গরুদের। হরিদ্রাক্ষপুরের শ্যাম গোয়ালা তো আর হালচাষ করা গেরস্ত নয় যে গরুদের বেঁধে রাখবে গোয়ালে, খেতে দেবে খড়-বিচালি। হরিদ্রাক্ষপুরে যাবার পর গরুরা সব ঘুরে বেড়ায় খোলা মাঠে, চরাচর জুড়ে কেবল স্বাধীনতা আর স্বাধীনতা। তাদের জন্য বরাদ্ধ থাকে কচি ঘাস, তিলের খৈল, ছোলার ডাল। আর থাকে অতিকায় এক ষাঁড়, ধ্বংসরোল।
ঘৃতকুমারী হরিদ্রাক্ষপুরে গিয়েছে।
নীলাম্বু আর কাঞ্জি? গেরস্ত বাড়ির এই বলদ দুটো এখনও বরাবরের মতো হাল বায়, খড় চিবোয়, সন্ধ্যে হলে জাবর কাটে চোখ বুজে। ষাঁড়ভাগ্য তাদের নয়।