বঙ্গোপসাগর ঘিরে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংযোগ, শিল্পায়ন ও বন্দরভিত্তিক লজিস্টিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক দশকেরও বেশি সময় আগে ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট’ বা বিগ-বি প্রকল্প হাতে নেয় জাপান। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিত এ মেগা প্রকল্পকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) বিকল্প হিসেবে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে জাপানের কৌশলগত অবস্থান জোরদারের প্রধান স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে।
বিগ-বি উদ্যোগে বাংলাদেশকে কেন্দ্রীয় হাব হিসেবে বিবেচনা করে জাপান। পরিকল্পনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম থাকবে বিদ্যমান বন্দর ও শিল্পনগরী হিসেবে এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ীকে গড়ে তোলা হবে গভীর সমুদ্রবন্দর, জ্বালানি ও লজিস্টিক হাব হিসেবে। এই অবকাঠামোর মাধ্যমে শিল্প উৎপাদন, বিদ্যুৎ–জ্বালানি সরবরাহ ও সমুদ্রবন্দরভিত্তিক বাণিজ্য একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার কথা ছিল। একই সঙ্গে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে সড়ক ও রেলপথে বাংলাদেশের বন্দরের সঙ্গে যুক্ত করে বঙ্গোপসাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল। নেপাল ও ভুটানের মতো স্থলবেষ্টিত দেশগুলোর জন্যও এটি নতুন বাণিজ্যিক দ্বার খুলে দেবে বলে আশা করা হচ্ছিল।
তবে ২০২২ সালে জাপানের অর্থনৈতিক মন্থরতা ও শ্রীলংকার দেউলিয়া হয়ে পড়ার পর প্রকল্পে দৃশ্যমান স্থবিরতা দেখা দেয়। এর পর থেকে অঞ্চলজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা, কূটনৈতিক টানাপড়েন এবং শাসন কাঠামোর দুর্বলতা বিগ-বি প্রকল্পের ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষ করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে, তা বিগ-বি প্রকল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে কেন্দ্র করে যে ‘হিন্টারল্যান্ড টু সি কানেক্টিভিটি’র ওপর প্রকল্পটির মূল ধারণা দাঁড়িয়ে আছে, তা বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতা ছাড়া কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে।
জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, পরিবর্তিত আঞ্চলিক পরিস্থিতির কারণে বিগ-বি উদ্যোগ আপাতত বাধাগ্রস্ত হলেও জাপান এ প্রকল্প থেকে সরে আসেনি। তার মতে, বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের জন্যও এ ধরনের আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্প বাস্তব গুরুত্ব বহন করে এবং ভবিষ্যতে সহযোগিতার পথ খুলে গেলে উদ্যোগটি আবার গতি পেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্পটি পরিকল্পনার সময় থেকেই ভারতকে বড় ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে বর্তমানে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপড়েন, জাপান-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা বিগ-বি উদ্যোগের জন্য প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারে সামরিক শাসন, সশস্ত্র সংঘাত ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটিকে ট্রানজিট করিডোর হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। একইভাবে শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকট দেশটিকে বড় আঞ্চলিক প্রকল্প থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
সব মিলিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, চীনের বিআরআইয়ের বিস্তার এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ঘাটতি বিগ-বি প্রকল্পকে গুরুতর ভূরাজনৈতিক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। যদিও জাপানের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল ও ভিশনের কারণে প্রকল্পটি পুরোপুরি বাতিল হবে না বলেই মনে করছেন কেউ কেউ, তবে নিকট ভবিষ্যতে এর বাস্তবায়ন সহজ হবে না—এটাই এখন বাস্তবতা।