১৫ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটি বাংলাদেশ সফর করবে। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন কূটনৈতিক পদক্ষেপ নয়; বরং বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে পাশে দাঁড়ানোর দীর্ঘদিনের অঙ্গীকারেরই অংশ।
বিগত বছরগুলোতে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বারবার এই আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমরা বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করি, যেখানে অধিকারসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমান হয়রানি ও দমনমূলক আচরণের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়।
আমাদের পার্লামেন্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশা নিয়েও সরব হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের নিন্দা জানিয়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে একটি বিশেষ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং মানবিক সুরক্ষা ও জবাবদিহির দাবি তোলা হয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার আয়োজনও করেছি আমরা—যা আমাদের ধারাবাহিক প্রতিশ্রুতির স্পষ্ট নিদর্শন।
আমাদের সফরটি এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুন গণতান্ত্রিক অধ্যায়ে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একইসাথে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তিতে ইইউ–বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব ক্রমে গভীর হচ্ছে। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলিকে স্বাগত জানাই—বিশেষ করে সংস্কার কমিশনের কাজগুলো, যা গণতান্ত্রিক শাসন, মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা।
এই পদক্ষেপগুলো প্রশংসনীয় হলেও, এখনও কিছু খাতে আন্তর্জাতিক মান পূরণের জন্য আরও অগ্রগতি প্রয়োজন—যেমন শ্রমিক অধিকার ও বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই প্রয়াসে বাংলাদেশের পাশে থাকতে প্রস্তুত।
আমাদের যৌথ অগ্রাধিকারের কেন্দ্রে রয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। নির্বাচন হতে হবে মুক্ত, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য—যা জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা যেকোনো রাষ্ট্রের সুষ্ঠু কার্যক্রমের জন্য অপরিহার্য। এই আস্থা গড়তে বাংলাদেশ যেভাবে সহযোগিতা চাইবে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেভাবেই প্রস্তুত রয়েছে।
ইইউ নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশন ২০২৪ ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ সরকারকে কিছু সুপারিশ দিয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সেসবের বাস্তবায়ন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
শুধু নির্বাচন নয়, আমাদের সফরে মানবাধিকারের বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলোও আলোচনায় আসবে। এর মধ্যে রয়েছে আইনের শাসন, নির্যাতন প্রতিরোধ, নাগরিক সমাজের কার্যকর ভূমিকা, লিঙ্গ সমতা ও নারীর অধিকার, সামাজিক অধিকার এবং জলবায়ু নিয়ে ন্যায়বিচার।
ইইউ–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন এক নতুন ও আশাব্যঞ্জক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, পাশাপাশি জিএসপি+ কাঠামোর আওতায় ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকারও অব্যাহত থাকবে। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের কাজ হবে এই নিশ্চয়তা দেওয়া যে মানবাধিকার ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলাই সহযোগিতার মূলভিত্তি—শুধু তবেই আমাদের সম্পর্ক প্রকৃত অর্থে বিকশিত হবে এবং বাংলাদেশি ও ইউরোপীয় নাগরিকদের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
লেখকঃ মুনির সাতুরি, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য (MEP) এবং মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির (DROI) চেয়ারম্যান