সর্বশেষ

‘অধিকার’-এর অভিযোগ

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা

প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০০
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেড়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যা

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসের দায়িত্বকালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি এমন অভিযোগ তুলেছে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। নতুন প্রতিবেদনে সংগঠনটি জানায়, গত দেড় বছরে দেশে অন্তত ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।

 

৩১ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ৯টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও ১১টি হত্যা নথিভুক্ত হয়েছে।

 

কারা দায়ী?

 

অধিকার জানায়, নিহতদের মধ্যে ১৯ জন গুলিতে, ১৪ জন নির্যাতনে এবং সাতজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক তিন মাসের ১১টি ঘটনার মধ্যে সাতটির জন্য যৌথবাহিনী, তিনটির জন্য পুলিশ এবং একটি ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীকে দায়ী করা হয়েছে।

 

২০২৪ সালের আগস্টে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি মাসেই নতুন হত্যার অভিযোগ যোগ হয়েছে। মোট হিসাব অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৪ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত অন্তত ৪০ জনের মৃত্যু হয়েছে বিচারবহির্ভূতভাবে।

 

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য অভিযোগ

 

অধিকার শুধু হত্যা নয়, আরও কয়েকটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে—

  • মব সন্ত্রাসে নিহত: ১৫৩ জন
  • সর্বোচ্চ সংখ্যা: সেপ্টেম্বর ২০২৫ (১৮টি ঘটনা)
  • রাজনৈতিক সহিংসতা: ৭,৯৭৯টি ঘটনা
  • রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত: ২৮১ জন
  • সাংবাদিক নির্যাতন: ২৪২টি হামলা

সাংবাদিকদের ওপর সবচেয়ে বেশি হামলা হয়েছে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে (৩৪টি ঘটনা)।

 

সরকার কী বলছে?

 

সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা ব্যক্তি—যেই এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকুক, আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে। তদন্ত চলছে।”

 

তবে এখন পর্যন্ত তদন্তের অগ্রগতি বা ফলাফলের কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিস্তারিত মন্তব্য দিতে পারেনি।

 

প্রধান উপদেষ্টার জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ—সব ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। কিছু শেষ হয়েছে, কিছু শেষের পথে। বিচারহীনতার সুযোগ নেই।”

 

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ: “বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই”

 

কুমিল্লার যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম যৌথবাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সবচেয়ে আলোচিত। তার ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, “জড়িতরা সেনাসদস্য। আদালত, মামলা—কিছুই করতে দেয়নি। আমাদের কথা শুনেনি, আসামিও করতে দেয়নি। সবাই বলছে বিচার হবে, কিন্তু কিছুই হয়নি।”

 

আজাদের কথায় আক্ষেপের সুর, “আমরা তো ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে পারবো না। বিচার হবে না, এটা বুঝে গেছি।”

 

অধিকারের অবস্থান: মন্তব্য এড়ালেন নেতারা

 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগে ‘অধিকার’-এর প্রধান ছিলেন আদিলুর রহমান খান। তবে এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। সংগঠনের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানও অতিরিক্ত মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

 

মানবাধিকার কর্মীদের উদ্বেগ

 

গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, “এগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। এখনো কোনো ঘটনার তদন্ত বা বিচার হয়নি। রাজনৈতিক ভাষা বদলায় কিন্তু বাস্তবতা বদলায় না।” তিনি মনে করেন, “পদ্ধতিগত পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যা কমেনি। অতীত সরকারের মতো একই ধরনের বক্তব্য আবার শোনা যাচ্ছে।”

 

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর এমন প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি। কমিশন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়—এটাই বড় ব্যর্থতা।”

 

তিনি আরও বলেন, “আইন পরিবর্তন করে কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানো ভালো উদ্যোগ, কিন্তু প্রয়োগ না হলে আইনের মূল্য নেই।”

 

আন্তর্জাতিক উদ্বেগও বাড়ছে

 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানায়, আইএসপিআর এবিষয়ে মন্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরও তদন্ত চলছে বলে মন্তব্য করেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করছে,

  • বিচার না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে
  • হত্যার পাশাপাশি মব সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়ছে
  • রাষ্ট্রের দায় এড়ানোর সংস্কৃতি অব্যাহত

অন্তর্বর্তী সরকার গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় এলেও বিচারবহির্ভূত হত্যার পরিসংখ্যান ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। সরকার তদন্তের কথা বলছে, কিন্তু ভুক্তভোগী পরিবারগুলো এখনো কোনো বিচার বা অগ্রগতির প্রমাণ দেখতে পাচ্ছে না।

সব খবর

আরও পড়ুন

মব সহিংসতা, গণপিটুনি ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে অক্টোবরে মানবাধিকার চিত্র উদ্বেগজনক

এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদন মব সহিংসতা, গণপিটুনি ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপে অক্টোবরে মানবাধিকার চিত্র উদ্বেগজনক

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অন্তত ৪০টি

মানবাধিকার সঙ্কটে দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অন্তত ৪০টি

আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২ দফা সুপারিশ ৬ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার

ড. ইউনূসকে খোলা চিঠি আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২ দফা সুপারিশ ৬ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার

অন্তর্বর্তী সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার আহ্বান ভলকার তুর্কের

অন্তর্বর্তী সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার আহ্বান ভলকার তুর্কের

বাংলাদেশের ‘বিতর্কিত’ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগে উদ্বিগ্ন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

বাংলাদেশের ‘বিতর্কিত’ সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগে উদ্বিগ্ন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৫ ব্রিটিশ এমপি

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ৫ ব্রিটিশ এমপি

সরকারের একপাক্ষিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

খাগড়াছড়িতে ধর্ষণ ও সহিংসতা সরকারের একপাক্ষিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

মানবাধিকার বিতর্ক ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে তোলপাড়

মৃত্যুশয্যায় সাবেক শিল্পমন্ত্রীর হাতে হাতকড়া মানবাধিকার বিতর্ক ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে তোলপাড়