ফ্রান্সভিত্তিক স্বাধীন মানবাধিকার সংগঠন ‘জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ)’ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার বিষয়ক উপকমিটির প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে এক জরুরি আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ভয়াবহ সংকটে পড়েছে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে এবং গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
জেএমবিএফ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের দমন এবং শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এই সময়ে নাগরিকরা ব্যাপকভাবে নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
সংস্থাটির দাবি, গত এক বছরে ৬৩৭ জন মানুষ সংগঠিত সহিংসতায় নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ২০৫ জন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। এছাড়া ৪ লাখেরও বেশি মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের হয়েছে এবং লক্ষাধিক গ্রেপ্তার হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কর্মী ও সমর্থক।
জেএমবিএফ-এর তথ্যমতে, ১১৬ জন সাবেক সংসদ সদস্যকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হত্যামামলায় ফাঁসিয়ে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৪ জন নারী। অনেকে আদালতে নিজেদের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেননি, বরং আদালত প্রাঙ্গণে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সংস্থাটি জানায়, গত এক বছরে ৭০ জনেরও বেশি ব্যক্তি হেফাজতে নির্যাতন, গুলি ও চিকিৎসা অবহেলায় নিহত হয়েছে। একই সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্থানে ব্যাপক হামলার ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ১,৪৯৪টি ভাস্কর্য ভাঙচুর, ১২০টি মাজার ধ্বংস, ১৭টি গির্জায় অগ্নিসংযোগ এবং ২,৪৪২টি ধর্মীয় সংখ্যালঘুবিরোধী হামলার ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে ১০৩টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৪৯ জনের স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তার এবং অন্তত ৩০০ একর জমি দখল করা হয়েছে। লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ভিত্তিক সহিংসতাও বেড়েছে। গত এক বছরে ৫০০-এরও বেশি এলজিবিটিকিউ+ ব্যক্তিকে মৌলবাদী গোষ্ঠী হামলা করেছে, যাদের মধ্যে অনেকেই হত্যাকাণ্ড, মিথ্যা মামলা, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র থেকে বহিষ্কারের শিকার হয়েছেন।
সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জেএমবিএফ। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ১৬৭ জন সাংবাদিকের স্বীকৃতি বাতিল, ২৬৬ জনের বিরুদ্ধে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের এবং অন্তত ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। পাশাপাশি ১,০০০-এরও বেশি সাংবাদিক চাকরিচ্যুত হয়েছেন এবং বহু মিডিয়া হাউস জোরপূর্বক দখলের শিকার হয়েছে।
আইনজীবীরাও নিরাপদ নন। গত এক বছরে ১,৫০০ জনের বেশি আইনজীবী হত্যা, গ্রেপ্তার ও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট ও নিম্ন আদালতে বিচারকদের ওপর রাজনৈতিক চাপ ও জোরপূর্বক অবসরের ঘটনাও ঘটেছে।
এসব পরিস্থিতিকে গভীর মানবাধিকার সংকট উল্লেখ করে জেএমবিএফ ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের কাছে আহ্বান জানিয়েছে, তারা যেন বাংলাদেশ সফরের সময় এসব লঙ্ঘন ও সহিংসতার বিষয় সরাসরি গুরুত্বের সাথে তোলেন এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেন।
সংস্থাটি বিশেষভাবে সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, নারী, শিশু, সংখ্যালঘু ও এলজিবিটিকিউ+ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। পাশাপাশি প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে জরুরি উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছে।
জেএমবিএফ আশা প্রকাশ করেছে, ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের এই সফর বাংলাদেশে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় একটি শক্তিশালী বার্তা দেবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয় ভূমিকা নিতে উৎসাহিত করবে।