চলতি বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক—এমনটাই জানিয়েছে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)। মঙ্গলবার প্রকাশিত সংস্থাটির মাসিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মব সহিংসতা, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, রাজনৈতিক সহিংসতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা জুলাই মাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা দ্বিগুণ
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্ট মাসে অন্তত ৩৯টি ঘটনায় ৭২ জন সাংবাদিক হত্যাসহ বিভিন্ন নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়েছে, ৩৩ জন হামলায় আহত হয়েছেন, পাঁচজন লাঞ্ছনার শিকার, ১১ জন হুমকির মুখে পড়েছেন এবং একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া দুটি মামলায় দুইজন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং অন্তত ১৯ জন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
গত ৭ আগস্ট গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তায় মো. আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮) নামে এক সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যাকাণ্ডকে আগস্ট মাসের ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
মব সহিংসতায় প্রাণহানি
আগস্টে মব সহিংসতা ও গণপিটুনির ঘটনা বাড়লেও প্রশাসনের কার্যকর পদক্ষেপ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আগস্ট মাসে অন্তত ৩৮টি ঘটনায় ২৫ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়েছেন। সংস্থার মতে, ন্যায়বিচারের অভাব এবং আইনের শাসনের দুর্বলতাই গণপিটুনির প্রবণতা বাড়িয়ে তুলেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও গ্রেপ্তার
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগস্ট মাসে অন্তত ৬৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় চারজন নিহত এবং ৫১৪ জন আহত হয়েছেন। যদিও এ সংখ্যা জুলাই মাসের তুলনায় কিছুটা কম। এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে অন্তত ১৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৭১২ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২২০ জন অজ্ঞাত।
এছাড়া রাজনৈতিক মামলায় অন্তত ৪৫৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৪২৮ জন। সারাদেশে যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানে আরও ৮ হাজার ৩৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা ও শ্রমিক নিহত
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে শত শত শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনাকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছে এইচআরএসএস। প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যা শিক্ষাঙ্গনে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে।
এছাড়া নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডে শ্রমিক আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে একজন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনাকে মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে নিন্দা জানায় সংস্থাটি। নিহত শ্রমিকের পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতনের চিত্র
আগস্ট মাসে অন্তত ৬৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৩ জন ১৮ বছরের নিচের শিশু-কিশোরী। উদ্বেগজনকভাবে ১৮ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণের পর তিনজনকে হত্যা করা হয়েছে। একই সময়ে ২৬ জন নারী ও কন্যাশিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। আগস্ট মাসে অন্তত ১৩৩ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছে এবং ১১৬ জন মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার।
এইচআরএসএস বলছে, আগস্ট মাসে সাংবাদিক নির্যাতন, মব সহিংসতা, নারী ও শিশু নির্যাতন, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং নিরাপত্তাহীনতার যে চিত্র দেখা গেছে, তা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। সংস্থাটি প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।