বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ (সংশোধনী) অধ্যাদেশ ২০২৫ মানবাধিকার, বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার অধিকারকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইন্টিন। সংস্থাটি বলছে, প্রস্তাবিত সংশোধনীটি টেলিযোগাযোগ আইনকে আধুনিকায়নের নামে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি ক্ষমতা অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এটি বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
নভেম্বর ২০২৫-এ খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে অনুষ্ঠিত জনপরামর্শ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে আর্টিকেল নাইন্টিন তাদের বিশ্লেষণ তুলে ধরে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সংশোধিত অধ্যাদেশটি কেবল প্রচলিত টেলিযোগাযোগ সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, অনলাইন সংবাদ ও স্ট্রিমিং সেবা, ই-কমার্স, অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থা, ক্লাউড সার্ভিস, ডেটা সেন্টার এমনকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সেবাকেও এর আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
আর্টিকেল নাইন্টিন–এর মতে, এতো বিস্তৃত পরিসরে একক আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কার্যত বিভিন্ন ভিন্নধর্মী খাতকে একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত কাঠামোর অধীনে এনে ফেলছে। যেখানে আগে টেলিযোগাযোগ আইন মূলত অবকাঠামো, স্পেকট্রাম ও মৌলিক সেবার ওপর সীমিত ছিল, সেখানে নতুন অধ্যাদেশ এখন কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ, ডেটা ব্যবস্থাপনা, প্রতিযোগিতা নীতি ও প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষমতা দাবি করছে।
এই বিস্তার বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছে আর্টিকেল নাইন্টিন। সংস্থাটি উল্লেখ করে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো বর্তমানে সাংবাদিকতা, রাজনৈতিক মতপ্রকাশ, ছাত্র রাজনীতি ও নাগরিক প্রতিবাদের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে এসব প্ল্যাটফর্মে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি আবু সাদিক কায়েম কর্তৃক সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, ব্যঙ্গাত্মক প্ল্যাটফর্ম ‘ইয়ার্কি’ ও একাধিক ফেসবুক পেজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার উদাহরণ দিয়ে আর্টিকেল নাইন্টিন দেখিয়েছে, কীভাবে ডিজিটাল আইনগুলো বিরোধী কণ্ঠ দমনে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে ‘ইন্টারমিডিয়ারি’ বা মধ্যস্থতাকারীর সংজ্ঞা এতটাই অস্পষ্ট ও বিস্তৃত যে প্রায় সব ধরনের ডিজিটাল সেবা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-এর নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এর ফলে সমালোচনামূলক কনটেন্ট অপসারণ, অতিরিক্ত সেন্সরশিপ এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।
আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অধ্যাদেশের কিছু ধারা অনুযায়ী বিদেশে হোস্ট করা কনটেন্ট বা দেশের বাইরে বসে প্রকাশিত তথ্যের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এতে দেশে ও প্রবাসে থাকা নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় ‘চিলিং ইফেক্ট’ তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করেছে আর্টিকেল নাইন্টিন।
প্রতিবেদনটি বিটিআরসির স্বাধীনতা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংশোধনী অনুযায়ী, কমিশনের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ, বরখাস্ত এবং কার্যপরিধি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা কার্যত বিলুপ্ত হবে এবং রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়ে কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অধ্যাদেশে নজরদারি ক্ষমতার ব্যাপক সম্প্রসারণও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে আর্টিকেল নাইন্টিন। এতে ইন্টারনেট ট্রাফিক সংগ্রহ, যোগাযোগ নজরদারি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের তথ্য সংগ্রহ ও এসব তথ্য আদালতে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রাখা হয়েছে যা সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের (আইসিসিপিআর) সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আর্টিকেল নাইন্টিন বলছে, অধ্যাদেশে ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তা, তথ্য সুরক্ষা, ন্যায়বিচার বা প্রতিকার পাওয়ার অধিকার সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট সুরক্ষা নেই। বরং এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি তৈরি করছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান পাবে।
সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, অধ্যাদেশটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী সংশোধন করতে, প্রকৃত অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক জনপরামর্শ নিশ্চিত করতে এবং ডিজিটাল অবকাঠামোকে জনগণের স্বার্থে পরিচালনার পথ বেছে নিতে।