ঢাকার পুরান অংশ একসময় ছিল সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের আঁতুরঘর। সরু অলিগলি, ঘিঞ্জি বাড়িঘর আর চরম বিশৃঙ্খলার মাঝেও এখনো টিকে আছে বহু পুরনো স্থাপনা। তবে এর অনেকগুলোই ভেঙে যাচ্ছে, দখল হয়ে গেছে কিংবা ধ্বংসের পথে। সংরক্ষণের নানা আশ্বাস এলেও কার্যকর উদ্যোগের অভাবে প্রশ্ন উঠছে—ঢাকার প্রত্নসম্পদগুলোর ভাগ্যে কী আছে?
সংরক্ষণের দায়-দায়িত্ব নিয়ে দোষারোপের খেলা
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, ঐতিহাসিক ভবন সংরক্ষণের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। অনুরোধ এলে তারা সহযোগিতা করবে। অন্যদিকে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর জানাচ্ছে, পুরনো স্থাপনাগুলো অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ অনেক। ঢাকা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা জানান, ২০১৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তারা পুরান ঢাকার দুই হাজারের বেশি বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। এর মধ্যে ৫–৬শ’ বাড়ির তালিকা আদালতে জমা পড়েছে। তবে সংরক্ষণ কার্যক্রমের জন্য দরকার বড় বাজেট, মালিকানা যাচাই ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ।
সংগঠনগুলোর দাবি: সরকারিভাবে সংরক্ষণ জরুরি
ঐতিহ্য রক্ষায় কাজ করা সংগঠনগুলো মনে করে, সরকারের উদ্যোগ ছাড়া এ সম্পদ রক্ষা সম্ভব নয়। সেভ দ্য হেরিটেজেস অব বাংলাদেশের পরিচালক সাজ্জাদুর রশীদ বলেন, “যদি কোনোভাবে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করে সরকার ভবনগুলো অধিগ্রহণ করে, তাহলে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে সরকারের আয়ও বাড়বে।”
আরবান স্টাডি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী তৈমুর ইসলাম বলেন, শুধু ভবন নয়, এলাকাকেও সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি রূপলাল হাউজসহ বহু স্থাপনা দখল ও ভাঙচুরের ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “এখনই উদ্যোগ না নিলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।”
কেবল ৩৫টি সংরক্ষিত, অথচ যোগ্য ভবন ২২০০-এর বেশি
ঐতিহ্য রক্ষাকারী সংগঠনগুলোর মতে, পুরান ঢাকায় অন্তত ২২০০টি ভবন সংরক্ষণের যোগ্য। অথচ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০২৪ সালের অগাস্ট পর্যন্ত ঢাকার মাত্র ৩৫টি পুরাকীর্তি তালিকাভুক্ত করেছে। এর মধ্যে সূত্রাপুর জমিদার বাড়ি ও রূপলাল হাউজ ১৯৮৯ সালে গেজেটভুক্ত হয়।
সূত্রাপুর জমিদার বাড়ি একসময় জমকালো স্থাপত্যশৈলীর জন্য বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এখন সেখানে ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন ও ব্যারাক গড়ে তোলা হয়েছে। ভেতরে প্রায় ৭০ পরিবার বসবাস করছে। অপরদিকে, রূপলাল হাউজের একাংশে সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার, আরেকাংশে মসলা ও পানের আড়ৎ চলছে। ভবনের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে, কারুকার্য নষ্ট হয়েছে।
বিউটি বোর্ডিং, মঙ্গলালয় ও অন্যান্য বাড়ির করুণ চিত্র
বিউটি বোর্ডিংয়ের পাশের জমিদার বাড়ি দোকান, সেলুন ও পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে রেখেছে। মঙ্গলালয় বাড়ি ব্যবহার হচ্ছে মসলার আড়ৎ হিসেবে। বাড়িটির মালিক দাবি করা সাইফুদ্দিন মিলন জানান, তিনি ২০১০ সালে বাড়িটি কিনেছেন এবং ভেঙে নতুন ভবন করার পরিকল্পনা রয়েছে তার।
নারিন্দায় শতবর্ষী স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন ও নাসিরউদ্দীন স্মৃতি ভবনও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। পুলিশ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপে নাসিরউদ্দীন ভবন রক্ষা পেলেও স্যুয়ারেজ পাম্পিং স্টেশন ভেঙে ফেলা হয়।
আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই
পুরাকীর্তি আইন বলছে, সরকার চাইলে ঐতিহাসিক স্থাপনা অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণ করতে পারে। প্রাচীন জিনিস ধ্বংস, পরিবর্তন বা বিকৃতির জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন থাকলেও প্রয়োগ দুর্বল। অনেক স্থাপনা ব্যক্তিমালিকানাধীন হওয়ায় মালিকরা বাজার চাহিদায় সেগুলো ভেঙে ফেলছেন। স্থপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, “সরকারি প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া এসব সম্পদ রক্ষা সম্ভব নয়।”
জাতীয় বিল্ডিং কোড ২০২০ ও রাজউকের ড্যাপ পরিকল্পনায় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের শর্ত নির্ধারণ করা হলেও মাঠপর্যায়ে তার প্রভাব নেই।
উদাসীনতা ও দখলদারির শিকার ঐতিহ্য
রূপলাল হাউজ, সূত্রাপুর জমিদার বাড়ি কিংবা বিউটি বোর্ডিং—সবখানেই চলছে দখল, ভাড়াটিয়া ব্যবসা ও সরকারি দপ্তরের ব্যবহার। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর স্বীকার করছে, সংরক্ষণে বড় বাজেট ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। রাজউকও বলছে, তাদের নজরদারির অভাবেই অনেক পরিবর্তন তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে।
সেভ দ্য হেরিটেজের সাজ্জাদুর রশীদ বলেন, “ঐতিহ্য ধ্বংস হলে শেকড়হীন প্রজন্ম গড়ে উঠবে।” তৈমুর ইসলাম সতর্ক করেছেন, “আস্তে আস্তে পুরান ঢাকা থেকে পুরনো স্থাপনার চিহ্ন মুছে যাবে।”
প্রশ্ন এখন—সরকার কি সময় থাকতে উদ্যোগ নেবে, নাকি ঢাকা হারাবে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য?